মিয়ানমার জান্তার বিতর্কিত নির্বাচনে চীনের ছায়া


মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে। এ নির্বাচন চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনের মাধ্যমে সংঘাতের অবসান নয়, বরং নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি প্রশ্ন ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে—এ নির্বাচনের মাধ্যমে কি সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে? আর এর পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে চীনের নাম। একদিকে সামরিক বাহিনীর অনুগত দল ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রচনা, অন্যদিকে নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে চীন মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামোয় নিজের প্রভাব নিশ্চিত করতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী এ বিতর্কিত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় চীন একদিকে জান্তাপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ রেখে প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত সহায়তা দিয়ে চলেছে।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আমন্ত্রণে মিয়ানমারের অন্তত ১০টি রাজনৈতিক দল বেইজিং সফর করেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালেই অন্তত পাঁচবার সফর হয়েছে। এসব সফরের নেতৃত্বে ছিল সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ও পিপলস পাইওনিয়ার পার্টি (পিপিপি)। সফরের অংশ হিসেবে নেতারা চীনের সেন্ট্রাল পার্টি স্কুল, গুইঝু বিগ ডাটা সেন্টার, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্মার্ট সিটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো পরিদর্শন করেন।
চীনের এসব সফরকে রাজনৈতিক সৌজন্যের চেয়ে বেশি কিছু মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এগুলো ‘প্রশিক্ষণমূলক দীক্ষা সফর’ যেখানে মিয়ানমারের নেতাদের দেখানো হচ্ছে কীভাবে গণতন্ত্রের কাঠামোর ভেতর থেকেও কর্তৃত্ববাদী শাসন বজায় রাখা যায়। নির্বাচন আয়োজনের পদ্ধতি, নিয়ন্ত্রিত ভোটার ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থার ব্যবহার শেখানো হচ্ছে এসব সফরে।
সাম্প্রতিক সফরগুলোয় ইউএসডিপির ১০ জন সদস্য, পিপিপির চারজন প্রতিনিধি এবং জান্তা-নিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও অংশ নেন। নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সংস্থা, যার দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন পরিচালনা, তার কর্মকর্তাদের এ সফরে অংশ নেয়া নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
২০২৪ সালের আগস্টে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আসন্ন জনশুমারি ও নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য ‘প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা’ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর থেকেই চীনা কূটনীতিকরা জান্তার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান থেইন সোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। বৈঠকগুলোতে দল নিবন্ধন, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচনী আইন নিয়ে আলোচনা হয়।
চীনের এ পদক্ষেপের পেছনে মূলত কৌশলগত স্বার্থ জড়িত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরের বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পের স্থিতিশীলতা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং বন্দর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতেই চীন মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকে সমর্থন করে আসছে। নির্বাচনকে চীন গণতান্ত্রিক রূপান্তর নয়, বরং একটি নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে।
অন্যদিকে, জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার এবং বেশ কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন এ নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, এ ভোট হচ্ছে সামরিক শাসনের বৈধতা দেয়ার একটি উপায় মাত্র। ফলে এ নির্বাচন ঘিরে মিয়ানমারের যুদ্ধ আরো তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের। মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিয়াসন বলেন, ‘সামরিক সরকারের পরিকল্পিত নির্বাচন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলো যদি ভোট কেন্দ্র, প্রার্থী বা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালায়, তাহলে তা ভয়াবহ প্রাণহানির কারণ হতে পারে।’
জান্তার পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে কিছু ক্ষুদ্র জাতিগত দলকে, যার মাধ্যমে সামরিক সরকার একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ চিত্র তুলে ধরতে চায়। তবে প্রধান বিরোধী দলগুলো যেমন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ও শান ন্যাশনালিটিজ লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এসএনএলডি)—নিবন্ধন থেকে বাদ পড়েছে বা নিষিদ্ধ হয়েছে।
এ অবস্থায় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে—বিশেষ করে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামকে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়ার জন্য কূটনৈতিকভাবে চাপ দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, চীনের এ চাপ আসিয়ানের মধ্যকার ঐক্যহীনতা আরো বাড়িয়ে তুলবে এবং জান্তার এ ভোট প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দান সহজ করে তুলবে।
ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের মিয়ানমার প্রোগ্রাম পরিচালক জেসন টাওয়ার বলেন, আসিয়ান যদি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে, তাহলে সেটি চীনের ভূমিকাকে বৈধতা দেয়ার নামান্তর হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের জন্য মিয়ানমার কেবল একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়, বরং একটি কৌশলগত প্রবেশপথ। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের দিকে তার সামুদ্রিক সংযোগ ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের গুরুত্ব অপরিসীম। এ করিডোরে থাকা পাইপলাইন, রেলপথ ও গভীর সমুদ্রবন্দরগুলো চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে যেখানে অন্য দেশগুলো পিছিয়ে এসেছে, সেখানেই চীন সামরিক জান্তার প্রতি নীরব সমর্থন দিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তারে সুযোগ খুঁজে পেয়েছে। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ, সফর, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে চীন নিশ্চিত করতে চাইছে—যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তা যেন তার স্বার্থের প্রতি অনুগত থাকে।
সব মিলিয়ে চীন মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চেয়ে স্থিতিশীল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকেই বেশি পছন্দ করে। যাতে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থ রক্ষা করা সহজ হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন একটি রাজনৈতিক চাল, যেখানে ভোট গণনা নয় বরং কে প্রার্থী হবে, কে নির্বাচিত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহল কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে—সেসব কিছুর পরিকল্পনা আগেই হয়ে গেছে। আর এর পেছনে চীনের কৌশলগত প্রভাব এখন স্পষ্ট।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক ব্রায়নি লাও বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্তমান দমনমূলক পরিবেশে কোনো নির্বাচনই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রহসন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এ প্রক্রিয়াকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করা এবং সামরিক জান্তাকে কোনো ধরনের কারিগরি সহায়তা না দেয়া।’