জামায়াতের জাতীয় সমাবেশ

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনে জোর বক্তাদের

আলোকিতপ্রজন্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২২ পিএম, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫ | ২৪৮
ছবি বণিক বার্তা

শুধু নির্বাচন দিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। এর আগে সংস্কার করতে হবে। যারা সংস্কার চান না, তাদের মতলব আছে। ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। যারা বলে নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চায় না, তারা জাতির সঙ্গে বেইমানি করে। এ পদ্ধতির নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখলের সুযোগ নেই, টাকা দিয়ে ভোট কেনার কোনো সুযোগ নেই। তাই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাদের মতলব পূরণ হবে না।

গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে বক্তারা জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটাতে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে জোর দিয়ে এসব কথা বলেন। এটিসহ সাত দফা দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। অন্য দাবিগুলো হলো জুলাই অভ্যুত্থানসহ ফ্যাসিবাদী আমলের বিভিন্ন সময় সংঘটিত সব গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ঐতিহাসিক জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ ও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিতকরণ।

দলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমাবেশের আয়োজন করে দলটি। সকাল ১০টায় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশের প্রথম পর্ব শুরু হয়। এরপর হামদ-নাত ও ইসলামী সংগীত পরিবেশন করা হয়। এ সময় গান, কবিতা, অভিনয়ের মাধ্যমে সাত দফা দাবির যথার্থতা তুলে ধরা হয়। বেলা ২টার দিকে কুরআন তিলাওয়াত ও নাতে রাসূলের মধ্য দিয়ে সমাবেশের মূল পর্ব শুরু হয়। নাতে রাসূল পরিবেশন করেন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা।

এ পর্বে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের বাচ্চু, গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ, নেজামে ইসলামের মহাসচিব মুসা বিন ইযহার, ঢাকা মহানগরী উত্তর জামায়াতের আমির মো. সেলিম উদ্দিন ও দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল।

সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে গত ১৬ বছর ধরে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজকের এ জনসমুদ্র গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি করেছে। ক্রসফায়ার, গুম ও হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর হাজার হাজার মানুষ। ওই সময় সবচেয়ে মজলুম দল ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আমরা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি কল্যাণ ও সুশাসনের রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই। তাই আসুন, ডা. শফিকুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে, জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করে আগামী নির্বাচনে তরুণরা যাতে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেয়—সেই স্লোগান তুলে ধরি। একই সঙ্গে এ স্লোগান নিয়ে ইসলামিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করি।’

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, ‘প্রত্যেকেই বলেন সংস্কার মানি। কিন্তু বৈঠকে বসলে কেউ কেউ “মানি না” ভাব দেখাচ্ছেন। সমস্যাটা কোথায়? সংস্কার তো সবার জন্য কল্যাণের। তাহলে যারা চান না, তাদের মতলব আছে! পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোট কেন্দ্র দখলের সুযোগ নেই, টাকা দিয়ে ভোট কেনার কোনো সুযোগ নেই। সেজন্য মতলব পূরণ হবে না। সুতরাং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করা মানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে তারা সচেতন নয়। অনেকেই বলেন, সংস্কারের আইনগত ভিত্তি কীভাবে দেব? আগামী সংসদে দেব। আপনারা কী মনে করছেন, আগামী পার্লামেন্টে আপনারা জিতবেন নাকি দখল করবেন। সুতরাং এসব কথা সমাজকে বিভ্রান্ত করবে। আমরা চাই নতুন বাংলাদেশ। আগামী নির্বাচনে জনগণ জিতবে, সেটিই জামায়াতে ইসলামীর চাওয়া।’

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে বিপ্লবী ভাইদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। আমিও নতুনভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে আজকে লক্ষ জনতার মঞ্চে হাজির হতে পেরেছি। আমার অতীত নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছে। জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে আমার ১০ জন ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। এ ১০ জনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য এ সরকারকে জোর দাবি জানাই এবং তাদেরকে শাস্তির বিধান করতে হবে। একই সঙ্গে সেসব পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘যে রক্ত এবং প্রাণের বিনিময়ে আমরা এ ঐতিহাসিক পরিবর্তন পেয়েছি, সেটিকে টেকসই করার জন্য মানুষ শাসনতান্ত্রিক ও সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের আওয়াজ উঠিয়েছে। সেজন্য সরকারকে বলতে চাই—সেই শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না করে নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না। নির্বাচনের আগে সব দল যেন নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ ও প্রচারণা চালাতে পারে, সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের অংশীজনরা, মজলুমরা অহংকারী হয়ে জালিম হয়ে উঠছে। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা যদি সীমা লঙ্ঘন করি, তাহলে শেখ হাসিনার মতো আমাদেরও আল্লাহ পাক ছাড় দেবেন না।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমাদ বলেন, ‘তিপ্পান্ন বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও ফ্যাসিবাদ থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পায়নি। এ দেশের মানুষ কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেনি। বরং লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ শোষণ-নির্যাতনের জন্য সব ইসলামিক দল, দেশপ্রেমিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।’

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘শুধু নির্বাচন দিয়ে এ দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সেটি সম্ভব হয়নি। এ দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে হলে নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারকে বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। যারা বলে উচ্চকক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে চাই না, তারা জাতির সঙ্গে বেইমানি করে।’

নেজামে ইসলামীর সভাপতি মাওলানা মুসা বিন ইজহার বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে মুজিববাদের ঠাঁই হবে না। আমাদের পরিচয় আমরা মুসলমান; আমরা বাংলাদেশী। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আগে বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন মেনে নেবে না। ফ্যাসিবাদী হাসিনাসহ অন্যদের বিচারের আগে এ দেশের মাটিতে নির্বাচন হতে পারবে না।’

কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম ও দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের যৌথ সঞ্চালনায় সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম, প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম, শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও কয়েকজন পঙ্গু জুলাই যোদ্ধা। সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমির মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা আবদুল হালিম, অ্যাডভোকেট মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, মাওলানা মুহাম্মাদ শাহজাহান ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, আবদুর রব, অধ্যক্ষ মো. শাহাবুদ্দিন, অধ্যক্ষ মো. ইজ্জত উল্লাহ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন প্রমুখ।

সমাবেশের সমাপনী বক্তব্য দেন সভাপতি জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান।

এদিকে, সমাবেশ উপলক্ষে একদিন আগেই সারা দেশ থেকে রাজধানীতে মানুষের ঢল নামে। জামায়াতে ইসলামীর লাখ লাখ নেতাকর্মী বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন বাহনে রাজধানীতে প্রবেশ করে। অনেকে আগের রাতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিল চিড়া, মুড়ি, খই, রুটিসহ বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার। সরজমিনে দেখা যায়, সমাবেশস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, মৎস্য ভবন, কাকরাইল, ফার্মগেট, রমনা পার্কসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা লোকে লোকারণ্য। দূরবর্তী জেলার নেতাকর্মীরা আগের দিনেই এসেছেন। ফুটপাত ও গাছের তলায় অবস্থান নিয়ে বক্তাদের বক্তব্য শুনছিলেন তারা।

সুত্র:বণিক বার্তা