প্রাকৃতিক বৈচিত্র চাঞ্চল্য মাতামুহুরী নদী হারাতে বসেছে নব্য ভাস্কর


প্রাকৃতিক বৈচিত্র ওদিক- চাঞ্চল্য মাতামুহুরী নদী কাকারায় আরেক মাদকতা। মাতামুহরী নদীরকূলে/ বালুর চরে উপর দাঁড়িয়ে নদী ও তার দুপাশে অনুপমতা সবুজাভপ্রসূনমন -প্রাণকে বিমুগ্ধ করে তোলে। এখানে ছ’মাস যেন বসন্ত। দক্ষিণ আর উত্তরে বিস্তর ফারাখ, একদিকে কাশ্মিরতা অন্য দিকে নেপাল। সমলতার মাঝে অরুণ প্রীতিতে চেয়ে অনেক নব্য ভাস্কর। মাতামুহুরী কাজল কালোজল, তার উপর পানির ঢেউ খেলানো জল, পাশে এলোমেলো পাহাড়ের সুবিন্যস্ত সজ্জা যেন নিঃসীম বিভোরতা।
এককালের খরস্রোতা মাতামুহুরীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা হ্রাস, তীরবর্তী জমিতে বেপরোয়া তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়েছে মাতামুহুরী নদীতে। এখন আর আগের মতো মাছ ধরা পড়েনা। মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ছে এই মৎস্য ভান্ডার। অতীত স্মৃতিগুলো এখন আর চোখে পড়েনা। যেমন এ নদী ছিল গভীর, গোসল করতে গেলে সাঁতার কাটাতাম। তখন দেখতে পেতাম শতশত বাশেঁর ভেলা নদী দিয়ে যাচ্ছে, নিমিষেই ভেলায় চড়ে ভাটির দিকে অনেকদুর চলে যেতাম…ওই মজাই আলাদা।’
স্মৃতি হাতড়িয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন প্রবীণ জনপ্রতিনিধি চকরিয়ার মাতামহুরী তীরের ইউনিয়ন সুরাজপুর-মানিকপুরের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম।
তিনি বলেন-‘আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন বর্ষা আসে তখন মাতামুহুরী অগ্নি মূর্তি ধারণ করত। নদীর দু’কুল উপচিয়ে টইটম্বুর বানের পানির সাথে আসা লাকড়ি ধরার মজাই ছিল আলাদা। আমরা তখন সবাই মিলে নদী তীরে লাকড়ী ধরা উৎসব পালন করতাম।’
নদী তীরবর্তী স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার এককারে খরস্রোতা প্রমত্তা নদী মাতামুহুরী তীব্র নব্যতা সংকটে পরেছে। মাতুমুহুরীর বুকজুড়ে জেগে উঠা মাইলের পর মাইল বালুচর। কালের পরিক্রমায় মাতামুহুরী নদীর চিরাচরিত স্বভাব পুরোটাই পাল্টে গেছে। মাতামুহুরী নদীকে ঘিরে চকরিয়া বাসীর অভিশাপ আর্শিবাদ দুটোই জড়িত। বর্ষায় বানের পানিতে ভাসে দু’কুলের বাসিন্দা। ভাঙ্গন আশংকা ছাড়াও জানমাল কেড়ে নেয় প্রমত্তা মাতামুহুরী। আবার শুষ্ক মৌসুমে খরস্রোতা মাতামুহুরী শুকিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ তখন কৃষি কাজে নেমে পরে নদী তীরবর্তী এলাকাজুড়ে।
কালের স্বাক্ষী মাতামুহুরী নদীর রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। এ নদীকে ঘিরেই এককালে এতদ্বঞ্চলে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতা। ইতিহাস থেকে জানা যায় বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তের ওপারে বার্মার আরকান রাজ্যের বিশাল পাহাড়, পর্বতমালা থেকে খরস্রোতা প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি। যা বান্দরবনের আলীকদম উপজেলার পাহাড়ী এলাকা কুরুপপাতা ও পোয়া মহুরী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। পরে ৪টি উপজেলা যথা আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়ার মাটি ভেদ করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিরামহীন চলার পথে আলীকদমের ইন্দু, সিন্দু, চকরিয়ার বাইস্যার ছড়া পর্যন্ত ১১৩টি ছোট বড় খাল ও ছড়া নদীতে মিশে গিয়ে মাতামুহুরীকে করে তোলে প্রাণযৌবন। আর এ নদীর তীরকে ঘিরে অত্র অঞ্চলে গড়ে উঠে প্রচীন সমাজ-সভ্যতা। তৎসময়ে লামা-আলীকদমের সাথে চকরিয়ার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল মাতামুহুরী নদীপথ। এককালে এই মাতামুহুরী নদীতে ভেসে চলতো বড় আকারের নৌকা ও সাম্পান। মানুষ একদিন একরাত নৌকায় চড়ে পরবাস খেটে লামা-আলীকদমে পৌঁছত। তখন নদী কেন্দ্রিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাতামুহুরীর তীরে গড়ে উঠেছিল সাপ্তাহিক বাজার। যেমন চকরিয়ার বদরখালী বাজার, বেতুয়াবাজার, তরছঘাট, পুর্ববড় ভেওলা বাজার, ফইন্না হাট, জালিয়া হাট, আইয়ুব আলী হাট, লামার চিরিঙ্গা বাজার, কোমার পাড়া হাট, মিনি বাজার, মাঝের পাড়ি বাজার, মানিকপুর বাজার, লামা বাজার ও আলী কদম বাজার।
সপ্তাহে দুইদিন এসব হাট বাজারে হরদম বেচাকেনা হত। ব্যবসায়ীরা নৌকায় করে সওদা নিয়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যাতায়াত করত। স্থানীয় ও প্রবীন ব্যক্তিরা জানায় এসব হাটে সকালে বেচা কেনা শুরু হত এবং দুপুর গড়াতেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু সে চিত্র আর নেই। নদীর উজানে অব্যাহত বৃক্ষ নিধন, অবাধে পাথর আহরণ,পাহাড়ী এলাকায় বসতি স্থাপন ও নদীর তীরে তামাক চাষের কারণে মাটি ক্ষয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদীর ভূমি ঢালু উত্তর-পশ্চিমমুখি। তাই এ জনপদের সভ্যতা সৃষ্টিকালীন মাতামুহুরী নদী সর্পিল গতিতে ক্রমশ বয়ে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে মাতামুহুরী নদীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ নদীর পানি যেমন কৃষকের ফসলে শক্তি যোগায়। তেমনি নানা প্রজাতির মাছ ধরে জেলেদের জীবন জীবিকার সহায়ক হতো। এক সময় স্থানীয় জেলেরা নৌকায় চড়ে নদীতে জাল ফেলত। সকালে মাছ ধরে বিকেলে বাজারে বিক্রি করে সংসার চলতো তাদের। চকরিয়ার সিংহভাগ মাছের চাহিদা মিটতো মাতামুহুরী নদীর মাছ দিয়ে। এখন সে নদী জেলেশূন্য। সব যেন এখন স্মৃতি।
মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, মাতামুহুরী নদীর দু’তীরে দীর্ঘ দু’দশকের ক্ষতিকর তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছের ওপর। তামাক ক্ষেতে অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ও নানা ধরণের কীটনাশক ছিটানো হয়। এসব কীটনাশক পানির সাথে মিশে নদীতে পড়ে। এতে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে এবং ছোট ছোট মাছ গুলি মরে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের মতে, তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও মাতামুহুরীতে মৎস্য সম্পদের বিলুপ্তি ঘটছে একশ্রেণির লোভী মৎস্য শিকারী ও উপজেলা মৎস্য অফিসের দায়িত্বহীনতার কারণে। মৎস্য বিভাগের দায়িত্ব অবহেলার কারণে জেলেরা নদীতে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে। এতে নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠে। বিশেষ করে বিষের কারণে চিংড়ি মাছ মারা পড়ে বেশী।
এছাড়াও নদীর যেখানে একটু গভীরতা আছে সেখানেই জেলেরা জঙ্গল কেটে ঘের তৈরি করে। কিছুদিন পর ঘেরের চারপাশে বিষ দিয়ে একশ্রেণির পাহাড়ি গাছের ফলের রস ছিটিয়ে মাছ আহরণ করা হয়। প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও এ নদীতে মাছ শিকার করা হয়।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ শিবলী মো. নোমান বলেন, মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী এলাকায় তামাক চাষ বন্ধে এ বছর উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নদীর তীরে তামাক চাষ বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হবে। নদীর তীরে তামাক চাষের কারণে মৎস্য ভান্ডারের ক্ষতির কথাও জানান তিনি