কেরোসিন তেল ব্যবসায়ী এখন বিদ্যা উপকরণ ব্যবসায়ী

মোজাম্মেল হক
প্রকাশিত: ১২:০০ পিএম, বৃহস্পতিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ | ২৪৪

এসেছিলেন তিনি অন্ধকার ঘরে বাতি জ্বালানোর ব্যবসা করতে কিন্তু হয়ে গেলেন আলো কেনাবেচার ব্যবসায়ী। প্রায় পঞ্চাশ যাবত একই ব্যবসা ধরে জীবনযাপন করছেন অথচ নিজের ঘরে নেই বাতি জ্বালানোর সামর্থ। নিজের টাকায় একটা ঘর দিবেন, নিজের ঘরে বাতি জ্বালাবেন  সেই সামর্থ তার হলো না। সারাজীবন থানাপাড়ায় অন্যের বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হয়েই রইলেন। বলছিলাম খাতা কলম ব্যবসায়ী সুকুমার সাহার কথা। 

প্রায় পঞ্চাশ  বছর হতে চললো তিনি টাঙ্গাইল শহরের নিউ মার্কেট এলাকায় ছোট্র দোকানে ছাত্রছাত্রীর কাছে খাতা কলম বিক্রির ব্যবসা করেছেন। অথচ শুরুটা করেছিলেন ১৯৭২ সালে কেরোসিন বিক্রির মাধ্যমে। তখন নিউ মার্কেটে এত দোকান ছিল না, প্রথম একটা মার্কেট তৈরী সালেহা নামে। 

শহরে বৈদ্যুতিক আলোর এত বাহার ছিল না, ছিল না বিভিন্ন রং বেরঙের  আলোর ঝলকানি। শহরে কিছু কিছু বাড়ীতে বৈদ্যুতিক আলো থাকলেও শহরের বাইরে ছিল না এত বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা। তারা বৈদ্যুতিক আলোর পরিবর্তে ব্যবহার করতো কেরোসিন তেলের হারিকেন ও কুপি। সুরুজ বড়রিয়ার খোপীপাড়া থেকে এসে সুকুমার সাহা সেই কেরোসিন তেল বিক্রির ব্যবসায় শুরু করেন ছোট্র শহরে। 

শুরুতে তিনি শহরের মসজিদ রোডের পাশে টিনের ট্যাংকিতে ভরে কেরোসিন তেল বিক্রি করতেন। তিনি স্মৃতি হাতড়ে সেই একদিনের গল্প বলেন“ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক আর্মি গাড়ী নিয়ে যাবার সময় আমার তেলের ড্রাম গাড়ী চাকায় পিষ্ট করে আমাকে লাথি দিয়ে ফেলে দেন, পরে গাড়ীতে বসা ছিল আরেক আর্মি গাড়ী থেকে নেমে আমার ভাংঙ্গা তেলের ড্রামের পাশে ১০ টাকা দিয়ে চলে যান। যা এখনও ভুলতে পারিনি”।

 পরে তিনি নিউ মার্কেট এলাকায় কেরোসিন তেল বিক্রি করার জন্য  ২০০ টাকায় দোকান ভাড়া নেন। এর পাশেই ছিল  ঐহিত্যবাহী বিন্দুবাসিনী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের হোস্টেল।  ছাত্রদের হোস্টেলের উত্তর দিকে ছোট্র খালের ওপাড়ে বিন্দুবাসিনীর স্কুলের মাঠ ও একতলা লম্বা স্কুল ভবন। দূরদূরান্ত থেকে স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের আবাসস্থল ছিল এই বিন্দুবাসিনীর হোস্টেল বা বোডিং হাউজ। তবে হোস্টেলে সবসময় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ছাত্ররা ছুটে আসতো কেরোসিন তেল  বিক্রেতা সুকুমার সাহার কাছে। তিনি ছাত্রদের চাহিদা পূরণ করতেন। তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অল্প পরিমানে খাতা কলমের ব্যবস্থা রেখে ছাত্রদের সেই চাহিদাও পূরণে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতেন। একসময় হোস্টেলের ছাত্রদের দেখাদেখি বিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রদের খাতা কলম কেনার স্থান হয়ে উঠলো সুকুমার সাহার দোকান।  দিনের পর দিন খাতা কলমের চাহিদা পূরণ এবং শহরে  ও গ্রামে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানিতে কেরোসিন তেলের ব্যবসা নেমে যেতে থাকলো। 

একসময় কেরোসিন তেলের ব্যবসা বাদ দিয়ে খাতা কলমের পাশাপাশি পড়ালেখায় সহযোগিতাকারী পেন্সিল, কাগজ, ক্যালেন্ডার, ভিউ কার্ডসহ বিভিন্ন মনিহারী দ্রব্য সামগ্রীতে দোকান পরিপূর্ন করে ফেলেন। ক্রেতাদের সাথে তার ব্যবহার ছিল মিসুক এবং দামের ক্ষেত্রে কম লাভে ব্যবসা করতেন। যে কারনে ছাত্রসহ অভিভাবকদের মনরক্ষা করতে পারতেন। শহরে খাতা কলমের দোকান থাকলেও তাঁর দোকানে এখনও ভিড় লেগেই আছে। তিনি খাতা কলমের ব্যবসা করেই জীবনপাত করলেন। তাঁর কাছে এই ব্যবসা করতেই ভালো লাগে। 

তিনি ছাত্রছাত্রীদের মাঝে খাতা কলম বিক্রি করে অন্যরকম আনন্দ পান। কারন খাতা কলম হলো বিদ্যা শেখার অমূল্য সম্পদ। তিনি তাঁর পুত্রের নাম রেখেছেন অমূল্য সম্পদ থেকে শুধু সম্পদ সাহা। সুকুমার সাহার একমাত্র  ছেলে সম্পদ সাহা এমবিএ কমপ্লিট করেছেন। আর কন্যা দৃষ্টি সাহা করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন।  স্ত্রী অমলা সাহার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। পচাত্তুর বয়সী সুকুমার সাহার বাবার নাম স্বর্গীয় মনিন্দ্রনাথ সাহা। ৭ ভাই ও ২ বোনের মাঝে সুকুমার সাহা হলেন সেজ। স্বগীয় দুই ভাই হলেন সিদ্ধার্থ সাহা ও সুব্রত সাহা। 

এছাড়া শুভঙ্কর সাহা, জয়দেব সাহা, সুদেব সাহা ও স্বদেশ সাহা। ভাইয়ের মধ্যে জয়দেব সাহাও প্রথমে ভাইকে ব্যবসায় সহযোগিতার পর পরে তার দোকানের পাশেই খাতা কলমের একটা দোকান দিয়েছেন।  বোন দুইজনের মাঝে শুভনা সাহা মারা গেছেন এবং সান্তনা সাহা এখনও বেঁেচ আছেন। সুকুমার সাহা যখন পরিবারের  জন্য দোকান ভাড়া নেন, তখন তার ভাড়া ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর এখন গোডাওনসহ ভাড়া ৮০০০ টাকা।

 সুকুমার সাহা বলেন“ তাদের পরিবারটি অনেক বড় হওয়াতে পড়ালেখা ঠিকমত করতে পারেনি। যে কারনে অল্প বয়সে ব্যবসায় নেমে পড়তে হয়েছে।” তিনি তার বাবা জীবন বীমা কর্পোরেশনের চাকরীজীবি স্বর্গীয় মনিন্দ্রনাথ সাহা সাথে তাদের বড় সংসার চালানোর পাশাপাশি ছোটভাইদের পড়ালেখা করতে সহযোগিতা করেছেন। তার ছোট ভাই শুভঙ্কর সাহা তার বড় সুকুমার সাহা ও তার বাবার সহযোগিতা নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। ভালো ছাত্র হওয়াতে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করেছেন। তিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা হয়েছিলেন। বর্তমানে ঢাকার নিজস্ব বাড়ীতে অবসর জীবনযাপন করছেন।

মাস্ট্রার্স পাস করা তার ছোট ভাই জয়দেব সাহা বলেন“ ভাইদের মধ্যে তিনি বড় হওয়াতে বাবার সাথে সংসারের দায়িত্ব পালনের সাথে আমাদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করেছেন। তার অবদান ভোলার নয়।”  

সুকুমার সাহার স্মৃতিতে এখনও মনে পড়ে নিরালা মোড়ের কাঠের সাঁকো কথা, পাশেই পার্ক বাজারে যেতে খাল হতে বাঁশের সাঁকো, ৮৮ বন্যায় তার দোকানে নৌকা নিয়ে খাতা কলম কিনে নিয়ে যেতেন সেই কথা, মনে পড়ে বিন্দুবাসিনীর স্কুলে ছোট্র ছেলেদের কথা। 

তিনি বলেন‘ বিন্দুবাসিনী স্কুলের ছোট্র ছেলেরা যখন বড় হয়ে আমার সামনে আসে, আমার নিকট পরিচয় দেয়, তখন খুবই ভালো লাগে, আমি ওদের না চিনতে পারলেও ওরা আমাকে চিনে, ভালবাসে। তাদের সেই স্মৃতি দিনের কথা বলে। আমি ওদের ভালোবাসায় পুলকিত হই।

তিনি আরোও বলেন“ হয়ত বিন্দুবাসিনী স্কুলে পড়তে পারেননি কিন্তু বিন্দুবাসিনী স্কুল ও ছাত্রদের প্রতি তার ভালবাসা ছিল এবং থাকবে।  তার প্রিয় স্কুল বিন্দুবাসিনী স্কুল। শিক্ষার সহযোগী উপকরন বিক্রি করে তিনি শিক্ষার মাঝে বেঁচে থাকতে চান।