দেশি বিদেশী অতিথিদের জন্য প্রস্তুত রণদা পূজামন্ডপ
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দেশি বিদেশী অতিথিদের অপেক্ষায় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার নীজ বাড়ির পূজামন্ডপটি। আর সে লক্ষেই তাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার দেবীর বোধন এবং খাটে তোলার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠিকতা এবং শুক্রবার থেকে স্বারম্বরে পূজা শুরু করেছে পূজারীরা।
শুক্রবার কুমুদিনী হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে পুরো চত্বর সাজ সাজ রব। রং তুলির আচরে এবং বর্ণীল আল্পনায় এক অপরুপ সাজে সেজেছে কুমুদিনী চত্বর। সেই প্রভাব পড়েছে লৌহজং নদী বিধৌত মির্জাপুর গ্রামের রণদা প্রসাদ সাহার নীজ বাড়িতে। নদীর ঘাটে প্রস্তুত রয়েছে নতুন রঙে রঞ্জিত বজরা নৌকা এবং একটি বড় ডিঙ্গি নৌকা। রণদা পূজা মন্ডপের পূজা দেখতে আসা দেশি বিদেশী অতিথিরা ওই নৌকায় পারাপার হবেন। তাছাড়া কুমুদিনী হাসপাতাল সংলগ্ন খেয়া ঘাটে বাশের শাকোটিও পূজা উপলক্ষে পাকা পোক্ত করা হয়েছে।
তিনশ বছরের ঐতিহ্যের ধারক তোরণ, আলোকস্বজ্জা বিহীন সাদামটা একটি পুজামন্ডপ।তবু সাদামাটা এই মন্ডপটি দুর্গোৎসবের সময় এখনও মির্জাপুর তথা টাঙ্গাইলের মূল আকর্ষণ। মির্জাপুর গ্রামের প্রায় শত বছরের প্রবীণ ব্যক্তি ঋষিকেশ সাহা জানান, এই মন্ডপের পূজাটি শরীকি হলেও ১৯৪২ সাল থেকে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা এককভাবে মহাধুমধামে পূজা করতে শুরু করেন।
তিনি জানান, প্রতিবছর পূজার সময় রাতে কোন বছর পাঁচ দিন, আবার কোন বছর সাত দিনব্যাপী যাত্রাপালার আয়োজন করতেন। যাত্রাপালা চলার সময়ে বাড়ির পশ্চিম পাশে রশিক ভবনের পেছনের বিশাল মাঠে লঙ্গরখানা খুলে প্রতিমা দর্শন ও যাত্রাপালা শুনতে আসা হাজার হাজার মানুষকে খাওয়াতেন। এই পূজামন্ডপকে কেন্দ্র করে মির্জাপুর পুরো গ্রামটিই জাতি-ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মিলনমেলায় পরিণত হতো।
১৯৫২ সাল থেকে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মহাষ্টমীর দিনে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ শুরু করতেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই বস্ত্র বিতরণের সময় দুর্ঘটনা ঘটায় তিনি পরবর্তীতে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রাখেন বলে জানান মির্জাপুর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি বয়োজোষ্ঠ ব্যক্তি অতুল প্রসাদ পোদ্দার।
পূজার সময় ১২ জোড়া ঢাকি ঢাক বাজাতেন, এছাড়া রশিক ভবনের পেছনে তৈরি করা প্রায় ৬০ ফুট উঁচুতে তৈরি করা নহবতখানা থেকে সানাই বাজানো হতো। এই যাত্রাপালায় সুদূর কলকাতার নাট্য কোম্পানির শিল্পীরাও অভিনয় করতেন।
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার দুর্গাপূজা উপলক্ষে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি বাড়িতেই নায়ড়ী-ঝিয়াড়ীসহ আত্মীয়-স্বজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত বলে জানা গেছে।
উপজেলা সদরের বাওয়ার কুমারজানী গ্রামের বাসিন্দা সাবেক কাউন্সিলর বয়োবৃদ্ধ হাজী সিরাজ মিয়া জানান, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির পূজাম-পের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে যাতায়াতের সুবিধার্থে আমরা মির্জাপুরের পাশের গ্রাম পুষ্টকামুরী শ্বশুড়ালয়ে পূজার সময়টাতে অবস্থান করতাম।
পুষ্টকামুরী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া জানান, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকার প্রতিটি বাড়িই আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর থাকত।
পুষ্টকামুরী গ্রামের ফজল মিয়া বলেন পূজার সময় রণদা প্রসাদ সাহা আয়োজিত যাত্রাপালা দেখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছি।
১৯৭১ সালের ৭ মে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার একমাত্র পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর দানবীরের পূজামন্ডপের অনেক কিছুই আর নেই, বিশেষ করে যাত্রাপালা ও লঙ্গরখানা।
নহবতখানায় কলকাতা থেকে আনা সানাইয়ের ক্যাসেট বাজানো হয়। নানা কারণে বস্ত্র বিতরণও সীমিত করা হয়েছে।
মির্জাপুরসহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলায় শারদীয় উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন পূজামন্ডপপে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তোরণ নির্মাণ করা হয়। করা হয় চোখ ধাধানো আলোজসজ্জা। দেশি-বিদেশি শিল্পী এনে আধুনিক ডিজাইনের প্রতিমাও তৈরি করা হয়। কিন্তু তারপরও সাদামাটা এই পূজামন্ডপটি এখনও মির্জাপুরের শারদীয় উৎসবের ঐতিহ্যের ধারক ও মূল আকর্ষণ হিসেবে অম্লান রয়েছে।
প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী সাদামাটা এই প্রতিমাটি দেখতে ভিড় জমান। এছাড়া দেশি-বিদেশি ভিআইপিদের ভিড়ও পূর্বের মতোই রয়েছে।
শামসুল ইসলাম সহিদ, ০৪-১০-২০১৯
