প্রবাসে থেকে দেশের
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিলেও পরিবারের নিরাপত্তা দিতে পারলাম না


প্রায় পঞ্চাশ বছরের ধলা খান। দীর্ঘ প্রায় একযুগ ধরে বিদেশ বিভূইয়ে জীবন বাজি রেখে পরিবার ও দেশের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, নিবেদিত প্রাণ ধলা খানের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমকে (৩৮) গত পহেলা জানুয়ারি বাসাইল উপজেলার নথখোলা পৌলী গ্রামের নিজ বাড়ির ঘরের ভেতর গলা কেটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। লোমহর্ষক এই ঘটনার প্রায় ২০ দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
তাই নিহতের স্বামী ধলা খান শোকার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘প্রবাসে থেকে জীবন বাজি রেখে দেশ ও পরিবারের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। কিন্তু দেশের জন্য অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারলেও পরিবারের নিরাপত্তা দিতে পারলাম না।’
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় সন্দেহভাজনদের নাম আলোচিত হলেও পুলিশ রহস্যজনকভাবে কাউকে আটক করেনি। পুলিশের এমন নিরব আচরণে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা। সবার একটাই প্রশ্ন এমন নক্ক্যারজনক ঘটনার কি কোন সুষ্ঠু সুরাহা হবে না ? তবে পুলিশের দাবি তদন্ত চলছে। খুব দ্রুতই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হবে।
গত ১২ জানুয়ারি সরেজমিন ঘটনাস্থলে যাওয়ার প্রাক্কালে ব্যাপক বেগ পেতে হয়। প্রত্যন্ত এলাকা এই নথখোলা পৌলী গ্রামটি। এই গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া প্রায় সবকটি রাস্তা কাচা ও ভাঙাচোরা। বর্ষাকালে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। গ্রামের এক প্রান্তে ধলা মিয়ার পৈত্রিক বসত ভিটা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির তিনদিকে খোলা প্রান্তর ও আবাদী জমি। একদিকে জনবসতি।
কয়েক বছর আগে ধলা মিয়ার অপর পাঁচ ভাই তাদের প্রাপ্ত বাড়ির অংশ বিক্রি করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসত গড়ে। আড়াই শতাংশ জমির উপর একটিমাত্র টিনের ঘরে একাই থাকতেন ধলা মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। একমাত্র ছেলে আলামিন প্রায় তিন বছর আগে বাবার মতো বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। স্বামী ও সন্তানকে ভিনদেশে পাঠিয়ে কোন রকমে খেয়ে পড়ে সাদামাঠা, নিরস জীবন-যাপন করতো মনোয়ারা বেগম।
মাঝে মাঝে বাবার বাড়ি ও দেবর-ভাসুরদের বাড়িতে যেত। তার পাশেই ছিল একমাত্র প্রতিবেশী আপন চাচা শ্বশুর মো. শহর আলী খানের বাড়ি। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল শহর খানের পরিবারের সাথেই ছিল তার সখ্যতা আবার নানা বিষয় নিয়ে বিরোধ। গ্রামে প্রবেশ করে বিভিন্ন জনের সাথে আলাপ করে এমন আভাসই পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, মনোয়ারা বেগম প্রায়ই বলতো শহর খান তাকে সেখানে থাকতে দিবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, মনোয়ারা বেগমের সাথে কারো কোন বিরোধ ছিলো বলে আমরা কখনো শুনিনি।
কালাম মাতাব্বর নামে জনৈক ব্যক্তি বলেন, পরিবারটির সাথে তাদের এক আত্মীয়ের টাকা নিয়ে বিরোধ ছিল। তিনি বলেন, শহর খান মসজিদ, মাদ্রায় জমি দান করেছেন। তিনি সামান্য কয়েক শতাংশ জমির জন্য এত বড় অন্যায় করবেন কেন ?
কেউ কেউ বলেন, বাড়িটির এক পাশে বসতি থাকলেও অন্য তিনদিকে ছিল খোলা প্রান্তর। কোন নিরাপত্তা বেষ্টনি ছিলনা। মাঝে মাঝে চুরির ঘটনা ঘটতো। গাছ ও ঝোপ-ঝাড়ে বাড়ির চারপাশে ভুতুড়ে পরিবেশ ছিল। এমন পরিবেশে বহিরাগত ও নেশাখোঁরদের আড্ডা থাকতে পারে।
মনোয়ারা বেগমের ভাসুর হেলাল খান বলেন, মনোয়ারার ঘরের সাথে শহর খানের ঘরের দূরত্ব দুই হাত। রাতের বেলা জলজ্যান্ত একজন মানুষকে গলা কেটে হত্যা করা হলো। পুরো ঘর জুড়ে রক্ত ছিটানো। অথচ পাশের ঘর থেকে তারা কোন ধরণের আর্তচিৎকারের শব্দ পায়নি বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক।
হেলাল খানের ছেলে দেলু খান জানান, প্রায় দুই বছর পূর্বে চাচী মনোয়ারাকে শহর খান ও তার ছেলে ঝগড়ার এক পর্যায়ে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা চেষ্টা চালায়। মাঝে মাঝেই তার বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটতো। সে একাধিকবার জিডি করেছে বলেও জানান তারা।
মামলার বাদী নিহতের ভাইয়ের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, প্রতিবেশী একটি পরিবারের সাথে জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। বিভিন্ন সময় হুমকি-ধামকি দিত। প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে পুলিশ আশার বাণী শুনালেও তারা এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে টাকা নিয়ে বিরোধের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
সবার অভিযোগের তীর যার দিকে সেই প্রতিবেশী চাচা শ্বশুর মো. শহর আলী খান বলেন, আমার এক ভাইয়ের বউ ফজিলা বেগমকে দাওয়াত দিয়েছিল মনোয়ারা। সকালে ফজিলা বেগম তার বাড়িতে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে প্রবেশ করে বিছানার উপর রক্তাক্ত গলা কাটা মরদেহ দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠে। পরে আমরা সবাই দৌড়ে আসি। সব সময় মনোয়ার আমাদের বাড়িতে যেত এবং আমরাও তার বাড়িতে আসতাম। মতবিরোধ থাকলেও তাকে হত্যা করার মতো যথেষ্ঠ কারন নেই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম লিটন বলেন, নিহত মনোয়ারার সাথে কারো কোন বিরোধ ছিল বলে আমার জানা নেই। তবে এমন নিরীহ একজন মানুষকে হত্যা করা হলেও খুনিরা ধরা ছোয়ার বাইরে থাকবে তা মেনে নেয়া যায় না। পুলিশের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তাজ উদ্দিন বলেন, মামলায় সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামী করা হয়নি। তদন্ত চলছে কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মামলার তেমন কোন অগ্রগতি না হলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে কোন ক্লু বের হয়ে আসতে পারে।
তবে বাসাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম তুহিন আলী মামলার তদন্ত অগ্রগতি অনেক দূর এগিয়েছে দাবি করে বলেন, তদন্তের স্বার্থে এই মুহুর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। খুব শীঘ্রই নৃশংস এই ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। যাচাই-বাছাই হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হয়েই আমরা তাদের গ্রেপ্তার করবো।