বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশু নির্যাতন ও শিশু হত্যা


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মানব জাতি। আর সেই মানব জাতিই যখন তার মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায় ঠিক তখনই সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। দেশের প্রেক্ষাপটে সমাজে এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রকৃষ্ট উদাহরণ শিশু নির্যাতন ও শিশু হত্যা।
শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। শিশুরা সুন্দরের ও পবিত্রতার প্রতীক। এছাড়াও শিশুরা নিস্বর্গ আনন্দের উৎস।
প্রতিটি শিশুকে সুন্দর ও সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ অত্যাবশ্যক। প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা নির্ভর করে একটি সুস্থ সুন্দর পরিবেশ এবং যে পরিবারে গড়ে উঠছে সেই পরিবারের মানুষের আদর যতœ, স্নেহমমতা ও প্রতিকুল পরিবেশের হাত থেকে রক্ষা করার সক্ষমতার ওপর ।
অর্থাৎ একটি সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সুস্থ পরিবেশ ও সঠিক পরিচর্যা। কিন্তু বর্তমানে শিশুরা কি সেই পরিবেশ পাচ্ছে? না। এর পরিবর্তে পাচ্ছে অসুস্থ, নিষ্ঠুর ও নির্মম পরিবেশ। যার ফলে প্রতিনিয়ত শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
বেসরকারি সংস্থা শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০৮৫ টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ জন, ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন এবং ২০১৫ সালে ২৯২ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। বিএসএফ এর মতে ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৫৮৯ টি শিশু সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয় এবং ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৮৪৫টি শিশু সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুরাও ধর্ষন নামক জঘন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যে শিশুটি এখনো ভালোভাবে হাটতেও শিখেনি তাকে কেন যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হেেচ্ছ তার উত্তর কি মিলবে তথাকতিত সুশীল সমাজের মানুষদের কাছে?
অপরাধ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিশু নির্যাতনের কয়েকটি উলেখযোগ্য কারণ তুলে ধরা হলো
প্রথমত ; শিশু নির্যাতনের প্রথম কারণ হলো দারিদ্রতা। আর্থিক সমস্যা শিশু নির্যাতনের পরিবেশ তৈরি করে। কেননা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলো শিশুদের জন্য সুস্থভাবে বেড়ে উঠার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিৎ করতে পারে না। এমনকি তারা শিশুদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো আহার তুলে দিতে পারে না। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে তারা শিশুদের দিয়ে উপার্জনমূখী কাজ করাতে বাধ্য হয়। যার ফলে কর্মস্থলে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়।
দ্বিতীয়ত ; শিশু নির্যাতনের আরেকটি কারণ হলো শিশুদেরকে সহজেই টার্গেট করা যায়। শিশুরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না বা রূখে দাড়াতে পারেনা। যার কারনে নির্যাতনকারীরা সহজেই তাদেরকে নির্যাতন করতে পারে। আর শিশুরা অভিযোগ করতে ভয় পায় বা লজ্জা পায় যার কারণে তারা নির্যাতনের শিকার হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কাউকে বলতে পারে না। বর্তমান সময়ে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে শিশুরা বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অনেক বেশি। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে কোলের শিশুও ধর্ষনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না । আর এক্ষেত্রে পরিচিত মানুষগুলো দ্বারাই এ নির্যাতন বেশি হচ্ছে। যার মধ্যে একটি শিশুর পরম নির্ভরতা তার শিক্ষক, পরিবারের সদস্য মামা, কাকা, দাদা এমনকি পিতার দ্বারাও নির্যাতিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত ; পারিবারিক কলহ। পারিবারিক কলহের কারণে মা-বাবার মধ্যে সমস্যার কারণে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়। মা বাবা নিজেদের মধ্যে বিবাদের কারণে তাদের নিরপরাধ শিশুরা আক্রান্ত হয়। এমনকি বিভিন্ন পরিবারের দ্বন্দের জেরে শিশুদেরকে সহজ টার্গেট হিসেবে নির্যাতন করে তাদের প্রতিশোধ নেয়।
চতুর্থত ; মোটা অঙ্কের আর্থিক লাভের আশায় শিশুরা অপহরন ও পাচারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এসব নির্যাতনকারীরা শুধু অপহরন ও পাচার করেই ক্ষান্ত হয় না, তারা এসময় শিশুদেরকে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে তাদের পিতামাতা বা অভিভাবকের উপর চাপ প্রয়োগ করে।
পঞ্চমত ; শিশুরা কোন অভিযোগ করলে তা অনেকসময়ই গ্রহন করা হয় না। অনেক সময় শিশু নির্যাতনের শিকার হলে বিভিন্ন কারণে পুলিশ তার অভিযোগটি গ্রহন করতে চায় না। এমনকি গ্রহন করলেও তদন্ত করতে গরিমসি করে থাকে। এসব কারণে নির্যাতনকারীরা ছাড়া পেয়ে যান। ফলে তারা আরও বেশি উগ্র হয়ে যায় এমনকি শিশুদেরকে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় শিশু নির্যাতন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়াটা একটা বিশাল সামাজিক সমস্যা। এর ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি অবহেলা ও আইন অবজ্ঞা করার মানসিকতা তৈরি হয়। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এরইমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
শিশু নির্যাতন বন্ধে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২০০০ গঠন করা হয়েছে। এতে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষের বিধান রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০১৩) অনুযায়ী যে সব অপরাধ এ আইনের অন্তর্ভূক্ত তা হলো- দহনকারী বা ক্ষয়কারী, শিশু পাচার, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুদের অঙ্গহানি, যৌন নির্যাতন অথবা হেনস্তা ইত্যাদি। বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০১৩) অনুযায়ী এসব অপরাধ প্রমানিত হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড থেকে মৃত্যুদন্ডও হতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে অর্থদন্ডের বিধান। একটি শিশু নির্যাতনের শিকার হলে সে দৈহিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। যার ফলে সে কখনোই সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। আমরা তো আর শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু একটা সমাজ কামনা করি না।
সুতরাং শিশু নির্যাতন বন্ধ করার জন্য দেশে বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে হবে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশকে উন্নত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। এই সমাজকে আবারও নৈতিক গুনাবলী দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে হবে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের আলোর শিখা। যাদের হাত দিয়েই দেশে নতুন আলোর সূর্য উদিত হবে। তাই তাদের নির্যাতনহীন এক সুস্থ, সুন্দর ও সঠিকভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের প্রত্যেকের একান্ত নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : সেতু সাহা। শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স বিভাগ। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল।