দেশে উগ্র ডানপন্থা উত্থানের পদধ্বনি!


বাংলাদেশ একটি বহুমাত্রিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দেশ। স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রটি নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন, মতাদর্শগত সংঘাত, ধর্মীয় আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং বিশ্বায়নের ধাক্কার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বাংলাদেশে ডানপন্থার রাজনীতি কখনো প্রান্তিক, কখনো মূলধারার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে উপস্থিত থেকেছে।
বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতান্ত্রিক কাঠামোর দুর্বলতা, তরুণ সমাজের হতাশা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বৈশ্বিক ইসলামোফোবিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত অভিবাসীদের প্রভাব এবং ডিজিটাল প্রচারণার সুযোগ নিয়ে উগ্র ডানপন্থা নতুনভাবে মাথাচারা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা শূন্যতা ও সামাজিক বিভাজনের পরিবেশে উগ্র ডানপন্থা (far-right/religious-extremist vigilantism) দ্রুত অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু মাইনরিটি ও অসহায় গোষ্ঠীগুলোর ওপর সহিংসতা, সম্পত্তি বিনষ্টকরণ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ডাক দেয় না বরং দীর্ঘমেয়াদিভাবে দেশের সামাজিক সংহতি, নাগরিক অধিকার ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে।
গত কয়েক বছর ধরে (বিশেষত ২০২৪-২০২৫ সালে) রাজনৈতিক টর্নেডো তথা গণআন্দোলন, সরকারের পাল্টা ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় ঘাটতি- এসব একযোগে কাজ করে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক সক্ষমতা ও সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এতে কিছু সংগঠিত ও অগঠিত দল- ভূমিধসের মতো স্থানীয়ভাবে অর্থ, রাজনৈতিক সুযোগ ও সামাজিক সম্মান ভোগ করতে গিয়ে উগ্রতা ও সহিংসতার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। নিরাপত্তা শূন্যতা ও প্রশাসনিক শিথিলতার সুযোগে আক্রমণ, ভাঙচুর ও ধর্মীয় ভিত্তিক হামলার হার বেড়েছে; বিশিষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগোষ্ঠীও এটি লক্ষ্য করেছেন।
উগ্রপন্থা শব্দটি মূলত ‘চরমপন্থা’ বা ‘একপাক্ষিক কঠোর অবস্থান’ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এটি রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ কিংবা চিন্তাাধারার ক্ষেত্রে এমন একটি মানসিকতা ও কর্মপদ্ধতিকে নির্দেশ করে যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের মতবাদ, আদর্শ বা স্বার্থকে একমাত্র সঠিক মনে করে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংসতা, ভয় প্রদর্শন, জবরদস্তি কিংবা অসহিষ্ণু আচরণ অবলম্বন করে। মূলত: উগ্রপন্থা মানে হলো- যেকোনো মতাদর্শ বা বিশ্বাসের প্রতি চরম আসক্তি, যেখানে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা থাকে না বরং সেই মত দমন করার জন্য সহিংসতা বা কঠোর পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
উগ্রপন্থার প্রকারভেদ বলতে আমরা সাধারণত ধর্মীয় উগ্রপন্থা, রাজনৈতিক উগ্রপন্থা, জাতীয়তাবাদী উগ্রপন্থা ও সামাজিক উগ্রপন্থাকে চিহ্নিত করতে পারি। ধর্মীয় উগ্রপন্থায় ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে সহিংসতা চালানো হয়(যেমন: জঙ্গিবাদ)। রাজনৈতিক উগ্রপন্থায় ক্ষমতা দখল বা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য চরমপন্থী আন্দোলন, বিদ্রোহ, হত্যা বা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কার্যক্রম চালানো। জাতীয়তাবাদী উগ্রপন্থায় অন্য জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেদের জাতিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের চেষ্টা করা। এবং সামাজিক উগ্রপন্থায় কোনো সামাজিক রীতি-নীতি বা সংস্কারের নামে ভিন্ন মতকে দমন করা হয়। এগুলোকে কখনো কখনো ‘ভিজিল্যান্টি’ বা ‘অধিকতর ধর্মীয় কঠোরতাবাদ’ বলা হয়। অতীতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ-সংশ্লিষ্ট সহিংসতা ছিল একটি আলাদা সমস্যা; এখন বিষয়টি আরও বিস্তৃত- অহেতুক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, মাইনরিটি লক্ষ্যমাত্রা ও সুশাসন- শূন্যতাকে ব্যবহার করে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যেসব কারণে উগ্র ডানপন্থার উত্থান ঘটে থাকে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- ১. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক শূন্যতা। রাজনৈতিক সংকট, সরকারের বদল, দুর্নীতির অভিযোগ এবং আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার মনোযোগ বিতরণে অনিশ্চয়তা- এসব আইনশৃঙ্খলা অচল বা অনুৎপাদনশীল করার পথ খুলে দেয়। যেখানে রাষ্ট্রীয় উপস্থিতি কমছে সেখানে স্থানীয় শক্তিগুলো দ্রুত পূর্ণ করে তোলে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে- নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফাঁক তৈরি হলে উগ্রবাদী দলগুলোর পুনরুত্থান সহজ হয়। ২. সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। বেকারত্ব, দারিদ্রতা, তরুণদের রাজনৈতিক অপ্রতিষ্ঠানিকতা ও অনলাইন-র্যাডিক্যালাইজেশনের সুযোগ- এসব মানুষকে সহজে প্রভাবিত করে। অর্থনৈতিক হতাশা কখনো নেতিবাচক পরিচয় খোঁজার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং গোষ্ঠীগুলো সেই শূন্যতাকে পূরণ করে। ৩. ভ্রান্ত রাজনৈতিক ধারক-বাহকরা ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন হওয়া। কখনো কখনো রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা ভুল বা শত্রুভাষ্য ব্যবহার করে বিদ্বেষ বাড়ান।
অপরদিকে অপরাধীর প্রতিশোধে সমাজিক স্বীকৃতি পায় বলে ভিজিল্যান্টি কর্মসূচি জনপ্রিয়তা পায়। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া দোষারোপ ও গুজব দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। ৪. অভিযান ও আইনি কার্যক্রমে প্রতিকূলতা। অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিচারব্যবস্থা, প্রমাণের ঘাটতি এবং বিলম্বিত বিচার- এসব অপরাধীকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বদলে আত্মসাৎমুখী করে তোলে। জঙ্গি-সমর্থক বা সন্ত্রাসী উপকরণ এখন অনলাইনে সহজলভ্য হওয়ায় পুনরাবৃত্তিরও ঝুঁঁকি বাড়ে।
অনুসন্ধানকৃত প্রতিবেদন ও স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী- আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত মাইন্ডারিটি নির্ভর প্রচন্ড সহিংসতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ (Bangladesh Hindu Buddhist Christian Unity Council) ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে দুই হাজার ৪৪২টি হেট-ক্রাইম রহপরফবহঃং রিপোর্ট করে- যেগুলোতে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, মন্দির ধ্বংস ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিনষ্টকরণ রয়েছে। এই পরিসংখ্যান স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে রিপোর্ট হয়েছে এবং এটি সংস্থাটির সংগ্রহকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশাল উদ্বেগের কারণ।
মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) দেশের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংস্থাকে সংস্কারের অভাব ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো নির্দেশ করা হয়েছে এবং তা উগ্র গোষ্ঠীগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে বলে সতর্ক করা হয়েছে। গবেষণা ও বিশ্লেষণিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সতর্ক করেছে যে, জঙ্গিবাদ-সংক্রান্ত আগের সফল দমন অভিযান সত্ত্বেও রাজনৈতিক শূন্যতা ও অনলাইন-প্রচারণার মাধ্যমে পুনরায় রেডিকালাইজেশন বাড়ার আশঙ্কা আছে; স্থানীয় প্রশিক্ষণ-নেটওয়ার্ক এবং সীমান্তিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অস্ত্র ও অর্থ সহজে দেশে প্রবেশ করছে- এসব জটিলতা পুনরায় বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি নিশ্চিতভাবেই বাড়ায়।
উগ্র ডানপন্থার ক্রমাগত উত্থানে দেশের সামাজিক ও সাম্প্রদায়িকভাবে প্রভাব পড়ছে। যেমন- (ক) ধর্মীয় ও ইথনিক মাইনরিটিজের ওপর প্রভাব। হেট-ক্রাইম ও ধর্মীয় স্থাপনা-ধ্বংসের ধারাবাহিকতা মাইনরিটিজকে আতঙ্কিত করছে; অনেকে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে। স্থানীয় অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অবনতি লক্ষণীয়। (খ) মহিলা ও শিশুদের উপর সহিংসতা। সামাজিক নিয়মের বাইরে বিচার বা গোষ্ঠীগত শাস্তি বা মব সন্ত্রাস যখন বাড়ে, তখন নারী ও শিশুদের সংরক্ষণের মর্যাদা কমে যায়; যৌন সহিংসতার ঘটনার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। (গ) শিক্ষা ও সেক্যুলার-সমাজের ক্রমশ অবনতি। শিক্ষক, লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা হুমকি ও হামলার ভীতিতে সামাজিক বিতর্ক ও মুক্ত চিন্তার পরিবেশ সংকুচিত হয়ে পড়ে। মুক্তভাবে আলোচনা ও বিতর্ক করা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। (ঘ) অর্থনীতি ও বিদেশি বিনিয়োগের প্রভাব। নিরাপত্তা-অবিশ্বাস ও নেগেটিভ রেপুটেশন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে এবং পেছনে ঠেলে দেয়; পর্যটন ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ বাড়ে।
উগ্র ডানপন্থার উত্থান রাষ্ট্র ও প্রশাসনের উপর অলিখিত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে উত্তরণের পথে হাটতে হচ্ছে। আইন প্রয়োগে ভরসা ও ক্ষমতার পুনঃসংখ্যা, প্রবিধানিক ও বিচারিক ব্যর্থতা এবং সামাজিক পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের ঘাটতিই রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতায় ফেলছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর চাপ ও রাজনৈতিক নির্দেশনা- কখনো তাদের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় ও কখনোই অনুকূলে ব্যবহার করা হয়না, ফলে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) ও অন্যান্য রিপোর্টে এসকল প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার উল্লেখ আছে। প্রসারিত মামলা-ব্যবস্থা, প্রমাণ সংগ্রহে সীমাবদ্ধতা ও সময়সাপেক্ষ বিচার- এসব অপরাধের দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গত বিচার আটকে দেয়। ফলত অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বিকার থেকে যায়, যা পুনরাবৃত্তিকে উৎসাহিত করে।
ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলোকে পুনর্বাসনে সরকারের কার্যক্রম সীমিত; নির্দিষ্ট আর্থিক ও নিরাপত্তা-সহায়তার অভাব লক্ষণীয়। এছাড়া গুজবের বিস্তারও রাষ্ট্রকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সংকটাবস্থায় সামাজিক মিথ্যা বার্তা ও গুজব ছড়িয়ে দিয়ে স্থানীয় দ্বন্দ্বকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে। তরুণরা অনলাইনে ভলনটিয়ারিং/রেডিক্যাল কনটেন্টে সহজে আকৃষ্ট হচ্ছে- তারা কখনো-কখনো নিজ শহরেই সহিংস ঘটনার অংশ হয়ে পড়ে। অনলাইন কন্টেন্ট-মনিটরিং ও ডিজিটালাইজেশনের দুর্বলতা রেডিকাল প্রভাবকে বাড়ায়।
ডানপন্থী শক্তি নির্বাচনকেও প্রভাবিত করছে। তারা কখনো বড় দলের সঙ্গে জোট করে সংসদে আসন পেয়েছে, আবার কখনো ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে জনমতকে প্রভাবিত করেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও বিভিন্ন ডানপন্থী সংগঠন নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে- সামাজিক মাধ্যমভিত্তিক প্রচারণা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের পুনর্গঠন, গ্রামীণ মসজিদ-মাদ্রাসা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের উগ্র ডানপন্থার ওপর আন্তর্জাতিক প্রভাব স্পষ্ট। ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান বাংলাদেশের ডানপন্থাকে উস্কে দিচ্ছে। পাকিস্তানে ঐতিহাসিক জামায়াতি নেটওয়ার্ক এখনও প্রভাব বিস্তার করছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী শ্রমিকদের একটি অংশ উগ্র মৌলবাদী মতাদর্শ নিয়ে দেশে ফিরছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইসলামোফোবিয়া বাড়ার কারণে বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে ‘পরিচয়ের সংকট’ তৈরি হচ্ছে- যা উগ্রবাদী সংগঠনগুলো কাজে লাগাচ্ছে।
আমরা উগ্র ডানপন্থা বা জঙ্গি বা কট্টর মৌলবাদের উত্থান রোধে কতিপয় প্রস্তবনা তুলে ধরছি। যেমন- ১. তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহনীর পুনর্গঠন ও দক্ষতা বৃদ্ধি। বিশেষ প্রশিক্ষণ (কমিউনিটি-পুলিশিং, মানবাধিকার ও হেট-ক্রাইম মোকাবিলা), দ্রুত প্রতিক্রিয়া ইউনিট গঠন এবং স্বাধীন তদন্তদল গঠন করা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (HRW) মতো পর্যবেক্ষক সংস্থার সুপারিশ এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে। ২. ন্যায়সঙ্গত ও দ্রুত বিচার ব্যবস্থার সংস্কার। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট প্রতিষ্ঠা করে হেট-ক্রাইম ও ভিজিল্যান্টি মামলাগুলো দ্রুততর বিচার নিশ্চিত করা; প্রমাণ সংগ্রহে আধুনিক টেকনিক ব্যবহার ও তদন্ত সংক্রান্ত কার্যক্ষমতা সহজলভ্য করা। ৩. হিংসার শিকারদের পুনর্বাসন ও মানসিক সহায়তা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও সম্প্রদায়কে আর্থিক সহযোগিতা, নিরাপদ আশ্রয় ও মানসিক স্বাস্থ্যের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাদের সাথে সমন্বয় করা যেতে পারে। ৪. সামাজিক সহনশীলতা বাড়াতে শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ। স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি স্তরে একাধিক কর্মশালা ও মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালু করে সহনশীলতা, pluralism ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো। অনলাইন-প্ল্যাটফর্মে যুবসমাজের জন্য প্রতিরোধমূলক কৌশল গড়ে তোলা প্রয়োজন।৫.অনলাইন ফ্যাক্ট-চেকিং ও গুজব দমন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত কনটেন্ট, ছবি বা অন্যকিছু দ্রুত ফ্যাক্ট-চেক ইউনিট গঠন করা ও গুজব শনাক্ত করার জন্য প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উস্কানিমূলক কনটেন্ট দ্রুত সরিয়ে ফেলা।৬.আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়। সীমান্তিক অস্ত্র, অর্থ বা প্রশিক্ষণ প্রবাহ রোধে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা সমন্বয় করা জরুরি। আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় কাউন্টার-রেডিকালাইজেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এবং ৭. স্বচ্ছতা ও সতর্কতা: গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা স্বীকৃতি। স্বাধীন মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি পশ্চাদপটে ঠেলে না রেখে তদন্তে সহায়ক করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গণমাধ্যমের জন্য সঠিক তথ্যপ্রদান নিশ্চিত করলে ভিত্তিহীন গুজব অধিকাংশ হ্রাস পাবে। এবং ৮. অবাধ নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সকল দলের রাজনীতি নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে উগ্র ডানপন্থার উত্থানের পদধ্বনি নিছক কল্পনা নয়; এটি বাস্তব ও গভীর সংকেত। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, উগ্রবাদ সমাজকে বিভক্ত করে, গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। উগ্র ডানপন্থার উত্থান দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ। এ উত্থান কোনো একক ইভেন্ট নয়- এটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার জটিল সমাহার। মাইনরিটি নিরাপত্তা, সামাজিক সংহতি ও দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষায় অবিলম্বে নীতি ও মাঠ পর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, সিভিল সোসাইটি ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া কঠিন। কঠোর আইন প্রয়োগ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এটা রোধ করা সম্ভব। সম্মিলিত উদ্যোগেই বাংলাদেশকে এই উগ্রতার পদধ্বনি থেকে মুক্ত করা সম্ভব। তাই এখনই রাষ্ট্র ও সমাজকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে- যাতে এই প্রবণতা ভয়ঙ্কর রূপ না নেয়।