নেপালে জেনজি আন্দোলন

ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:১১ পিএম, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৫১

নেপালে জেনারেশন জেডের আন্দোলন চলাকালে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি এসব ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে তদন্তের ঘোষণা দেন এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। অন্যদিকে, লুটপাট করা জিনিসপত্র কেনাবেচা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে সতর্ক করেছে নেপাল পুলিশ। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চন্দ্র কুবের খাপুং জানিয়েছেন, যারা পুলিশি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গতকাল নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি দেশজুড়ে ‘জেন জেড’ বিক্ষোভের সময় সংঘটিত সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার ঘোষণা দেন। সিংহদরবার সচিবালয়ে নবনির্মিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ভাষণে তিনি বলেন, ‘যে ধরনের অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর হয়েছে তা একটি পরিকল্পিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। যারা দায়ী তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।’

কার্কি আরো বলেন, ‘বিক্ষোভকালে নিহতদের শহীদ ঘোষণা করা হবে। নিহতদের পরিবারকে ১ মিলিয়ন নেপালি রুপি ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।’ ধ্বংস হওয়া পুলিশ ফাঁড়িগুলো অতি দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন তিনি। কার্কি বলেন, ‘এসব অপরাধমূলক ঘটনা অবশ্যই তদন্ত করতে হবে, সত্য প্রকাশ্যে আনতে হবে। দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ তিনি দেশের সঠিক পথনির্দেশে সবাইকে সমবেত প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

কার্কি জানান, সিংহদরবার, সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তিতে ভাংচুরের ঘটনাগুলোও তদন্ত করা হবে। একই সঙ্গে তিনি সবার প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

এদিকে ‘জেন জেড’ আন্দোলনের সময় লুট হওয়া পণ্য বাজারে বিক্রি ও বিতরণের খবর পাওয়ার পর নেপাল পুলিশের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিআইবি) জনগণকে এসব পণ্য কেনাবেচা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে, লুট হওয়া কিংবা চুরি করা পণ্য কেনা, বেচা বা মজুদ করলে বিদ্যমান আইনের আওতায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। গতকাল সিআইবি এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিক্ষোভ চলাকালে সরকারি ও বেসরকারি ভবন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আর্থিক সংস্থা ও অন্যান্য স্থাপনা থেকে নথি, ঐতিহাসিক দলিল, মূল্যবান সামগ্রী, অস্ত্র ও নগদ অর্থ লুট করা হয়েছে। লুট হওয়া পণ্য বিভিন্ন উপায়ে বাজারে বিক্রি ও বিতরণের তথ্য পাওয়া গেছে। সিআইবি বিষয়টি তদন্ত করছে। তাই জনগণকে অনুরোধ করা হচ্ছে এসব পণ্য ক্রয় বা বিক্রয় না করতে।

নেপাল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চন্দ্র কুবের খাপুং বলেছেন, পুলিশকে সমাজ থেকে হটানোর চেষ্টা করা ব্যক্তিরা অপরাধী। এ ব্যাপারে সমাজের অবস্থানও পরিষ্কার। তিনি বলেন, ‘দেশ এমন এক ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা কখনো পূরণ করা যাবে না। এতে আমাদের সবার মন ব্যথিত হয়েছে। নেপাল পুলিশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের অনেক থানায় আগুন দেয়া হয়েছে, গাড়ি থেকে শুরু করে ইউনিফর্ম পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এ কারণে নিয়মিত দায়িত্ব পালনে আমরা চরম সমস্যায় পড়েছি। এ সংকটময় সময়ে শত্রুতা ও প্রতিশোধ ভুলে নেপাল পুলিশ দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও সম্প্রীতি রক্ষায় ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।’

নেপালের কর্নালি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যমলাল ক্যান্ডেল বলেছেন, জেনজি আন্দোলনের নামে সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাংচুর ক্ষমাহীন অপরাধ। এ ঘটনায় তার নিজের বাড়িও পোড়ানো ও লুটপাট করা হয়েছে। ক্যান্ডেল বলেন, ‘অপরাধীরা যেন আইনের মুখোমুখি হয়, সেজন্য আমি নিজেই জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে লিখিত আবেদন করেছি। আমার বাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পর পুলিশকে চিঠি দিয়েছি ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিতে এবং আইনি পদক্ষেপ নিতে।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমি যদি ভুল করে থাকি তবে শাস্তি ভোগ করতে রাজি, কিন্তু উল্টোভাবে আমাকে অপরাধীর মতো দেখানো হচ্ছে। মাত্র দুইদিনের আন্দোলনে যে ধ্বংস হয়েছে, তা ১০ বছরের মাওবাদী যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। এতে নেপালের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা ও নথি ধ্বংস হয়েছে।’

গত শনিবার থেকে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরেছে নেপালে। এরই মধ্যে আন্দোলনের সময় সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। নতুন বানেশ্বরের ফেডারেল পার্লামেন্ট ভবন কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভেতরে কেবল ঘেরা দেয়াল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পার্লামেন্ট সচিবালয়ের মুখপাত্র একরাম গিরি জানান, বানেশ্বরের সংসদ ভবনের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। কোনো সামগ্রী চেনার উপায় নেই। ভবনের ভেতরে থাকা সার্ভারসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি-সরঞ্জাম ধ্বংস হওয়ায় সংসদ কার্যক্রম চালানো অসম্ভব।

অর্থনীতিবিদরা অনুমান করছেন, এ সংঘাতের পরোক্ষ ক্ষতি প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন রুপি, যা নেপালের দেড় বছরের বাজেট বা মোট জিডিপির অর্ধেকের সমান। সরকার ও বেসরকারি খাতের অবকাঠামো ও নথি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ১ শতাংশের কম হবে বলেও আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ চন্দ্রমণি আঢ্যাকি। আগামী মার্চে নির্বাচনের জন্য আরো ৩০ বিলিয়ন রুপি ব্যয় হবে, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রভাব ফেলবে। আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতায় থামেল, দরবার স্কোয়ার, পোখারা ভৈরহাওয়া, বিরাটনগর, চিতওনসহ প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিক্ষোভে হোটেলে ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে, ব্যাহত হয়েছে ভ্রমণ। পর্যটন মৌসুম শুরুর আগেই ব্যাপক হারে হোটেলগুলোর বুকিং বাতিল হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটির পর্যটন খাত প্রায় ২৫ বিলিয়ন রুপির ক্ষতির মুখে পড়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুর হিলটন হোটেলে এককভাবে ক্ষতির পরিমাণই ৮ বিলিয়ন রুপির বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভাট-ভাটেনি সুপারমার্কেটের ২৮টি আউটলেটের মধ্যে ২১টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় দুই হাজার হোটেল কর্মীর উৎসবকালীন জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে। হোটেল, অটোমোবাইল ডিলার ও ভাট-ভাটেনি সুপারমার্কেটের হিসাব অনুযায়ী, সহিংসতায় প্রায় ১০ হাজার নেপালিকে রাতারাতি বেকার করেছে। পরিবহন খাতের ক্ষতি প্রায় ১৫ বিলিয়ন রুপি।

তবে ছাই থেকে উঠে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছেন নেপালের বিনিয়োগকারীরা। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবসা পুনর্নির্মাণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নেপাল অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্টস। নেপাল স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে জানিয়ে পর্যটনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংগঠনটি।