“রবিউল আউয়াল: রাসূল ﷺ এর সীরাত থেকে শিক্ষা


রবিউল আউয়াল মাস ইসলামি ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এই মাসেই সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, বিশ্বজগতের রহমত, মানবতার মুক্তির দূত, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা ﷺ জন্মগ্রহণ করেন। আবার এই মাসেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তাই রবিউল আউয়াল মাস মুসলমানদের জন্য আনন্দ ও বেদনার সমন্বিত স্মৃতির মাস।
রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল, যিনি দুনিয়ার অন্ধকার দূর করে সত্য ও ন্যায়ের আলো ছড়িয়ে দেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক আমাদের জন্য আদর্শ।
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম জীবনাদর্শ।” (সুরা আহযাব: ২১)
নবী করিম ﷺ শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। মক্কার মানুষ তাঁকে ‘আল-আমিন’ (অতীব বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। দাওয়াতি জীবনে তিনি ধৈর্য, সহনশীলতা, মমতা ও দয়া প্রদর্শন করেছেন। তিনি ক্ষুধার্তকে খাইয়েছেন, এতিমের মাথায় হাত বুলিয়েছেন, অত্যাচারীর সামনে সত্য উচ্চারণ করেছেন।
রাসূল ﷺ শুধু ধর্মীয় নেতা নন; তিনি আদর্শ স্বামী, দয়ালু পিতা, সুবিচারক শাসক এবং অসাধারণ সেনাপতি ছিলেন। তাঁর সীরাতের প্রতিটি অধ্যায় মানবতার জন্য শিক্ষা ও প্রেরণার উৎস।
আজকের সমাজে অশান্তি, বিভেদ, অন্যায় ও দূর্নীতি দূর করতে হলে আমাদের রাসূল ﷺ-এর সীরাত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাঁর দেখানো দয়া, সততা, ন্যায়বিচার ও মানবসেবার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
রবিউল আউয়াল মাস আমাদের জন্য শুধু উদযাপনের নয়; বরং নবীজীর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার মাস। তাঁর সীরাতকে অনুসরণ করলেই দুনিয়ার অশান্তি দূর হবে এবং আখিরাতে মুক্তি লাভ করা যাবে।
“সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবারে জন্ম নেয়া নবী ﷺ”
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ﷺ-কে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। হযরত আদম আ: হতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা ও মাতা পর্যন্ত পূর্ণ বংশধারায় যতজন পুরুষ ও মহিলা রয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন পূত -পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ;কারো বংশ বা জন্মের সাথে ব্যভিচারের সামান্যতম সম্পর্কও ছিল না। তারা সকলেই ছিলেন বৈবাহিক ধারার মাধ্যমে জন্ম লাভ কারী। তিনি শুধু একজন নবী নন, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা মানবজাতির জন্য আবশ্যক।
১. শৈশব ও কৈশোর
রাসূলুল্লাহ ﷺ জন্ম থেকেই এতিম ছিলেন। অতি অল্প বয়সে পিতামাতা দুজনকেই হারান। দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বড় হন।
রাসূল ﷺ শৈশবকাল থেকেই সততা, আমানতদারিতা এবং সত্যবাদিতার জন্য পরিচিত ছিলেন। ছোটবেলায়ই এতিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো হতাশ হননি। সমাজের অন্যায়-অবিচারের মাঝেও পরিচ্ছন্ন চরিত্র বজায় রেখেছিলেন।
২. ব্যবসায়ী জীবন
কৈশোরে তিনি বাণিজ্যে যুক্ত হন। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জন করেন। লেনদেনে প্রতারণা থেকে দূরে থেকে ‘আল-আমিন’ তথা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত হন।
৩. পারিবারিক জীবন
তিনি একজন আদর্শ স্বামী ও পিতা ছিলেন। স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সন্তানদের প্রতি স্নেহশীলতা তাঁর পারিবারিক জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গৃহকর্মে সহযোগিতা করা, পরিবারকে ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা ছিল তাঁর অভ্যাস।
৪. দাওয়াতি জীবন
৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নির্যাতন, উপহাস, বর্জন—সবকিছুর পরও ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে তিনি দাওয়াত চালিয়ে যান। সত্য ও ন্যায়ের আহ্বান থেকে তিনি এক মুহূর্তও পিছপা হননি।
৫. নেতা ও শাসক হিসেবে
মদিনায় হিজরতের পর তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা নন, বরং রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও ভূমিকা পালন করেন। তিনি ন্যায়ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম সবার অধিকার নিশ্চিত ছিল।
৬. যুদ্ধক্ষেত্রে
রাসূল ﷺ ছিলেন একজন সাহসী সেনাপতি। তবে তিনি কখনো অকারণে যুদ্ধ করেননি।রাসূল ﷺ যুদ্ধ করতে কখনো নিজে থেকে আগ্রহী হননি, বরং আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর যুদ্ধগুলো ছিল আত্মরক্ষামূলক। যুদ্ধেও তিনি মানবিকতা বজায় রাখতেন—শিশু, নারী, বৃদ্ধ, গাছপালা ও প্রাণীর ক্ষতি না করার নির্দেশ দিতেন।
৭. দয়া ও মানবসেবা
রাসূল ﷺ ছিলেন সমগ্র মানবতার জন্য রহমত।তিনি এতিম, দরিদ্র, বিধবা ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াতেন। পশুপাখি পর্যন্ত তাঁর দয়ার ছোঁয়া পেত।ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো, দাসমুক্তি, এতিমের যত্ন, অসুস্থের খোঁজখবর নেওয়া ছিল তাঁর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেছেন—
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।” (তিরমিজি)
৮. “সৃষ্টির প্রতি মমতা: রাসূল ﷺ এর শিক্ষা”
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, (একবার) আমরা রাসূল সা: এর সাথে এক সফরে ছিলাম। একসময় তিনি হাজত পূর্ণ করতে গেলেন। এ সময় আমরা দুটি বাচ্চা সহ একটি “হুম্মারা” দেখতে পেলাম। (লাল ঠোঁট বিশিষ্ট এক প্রকার ছোট পাখি) আমরা তার বাচ্চা দুটি ধরে আনলাম। অতঃপর হুম্মারা(পাখি) টি এসে তার দুই ডানা মাটির উপর চাপড়াতে লাগলো। এরপর নবী সা: আসলেন। পাখিটিকে তড়পাতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন , কে এর বাচ্চাগুলি এনে একে ব্যথিত করছে । তার বাচ্চাগুলি তাকে ফেরত দিয়ে দাও।
এরপর নবী সা:পিপড়ার একটি বস্তি দেখলেন। আমরা তা জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে এটা জালিয়েছে। বললাম আমরা। তিনি বললেন, অগ্নির প্রভু ব্যতীত অন্য কারো জন্য অগ্নি দারা শাস্তি দেওয়া উচিত নয় । (আবু দাউদ)
উপসংহার
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবনের প্রতিটি দিক—শিশু, ব্যবসায়ী, স্বামী, পিতা, দাওয়াতকারী, নেতা, শাসক ও মানবসেবক—সবই মানবজাতির জন্য শিক্ষা। যদি আমরা তাঁর সীরাতকে অনুসরণ করি, তবে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আখিরাতে মুক্তি লাভ করব।
“আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রাসূল ﷺ এর সীরাতের আলোকে জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।”
লেখক
হাফেজ মাও: মুফতি মো: রফিকুল ইসলাম
ইমাম ও খতিব
টাঙ্গাইল পুরাতন বাস স্ট্যান্ড জামে মসজিদ।