নেপালজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, নিহত ১৯

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৫৭ পিএম, সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৯২

রাজধানী কাঠমান্ডুসহ নেপালের অধিকাংশ শহরে ছড়িয়ে পড়েছে সরকারিবিরোধী বিক্ষোভ। আজ সোমবার এ বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে ১৭ জনই নিহত হয়েছেন কাঠমান্ডুতে। দুর্নীতি ও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের ঘোষণার বিরুদ্ধে জেনারেশন জেড নেতৃত্বাধীন এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে কাঠমান্ডু, পোখারা, বুটওয়াল, ভৈরহাওয়া, ভরতপুর, ইটাহারি ও দামাকসহ বহু শহরে। সকালে রাজধানীর নিউ বানেশ্বর এলাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে শুরু হওয়া আন্দোলন দুপুরের পর দ্রুত বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাঠমান্ডুসহ বেশ কয়েকটি শহরে কারফিউ জারি করলেও উত্তেজনা কমেনি। নামানো হয়েছে সেনাবাহিনীও।

হাসপাতাল সূত্রের বরাতে হিমালয়ান টাইমস জানায়, শুধু কাঠমান্ডুতেই ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে—এর মধ্যে জাতীয় ট্রমা সেন্টারে ৮ জন, এভারেস্ট হাসপাতালে ৩ জন, সিভিল হাসপাতালে ৩ জন, কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজে ২ জন এবং ত্রিভুবন টিচিং হাসপাতালে ১ জন। এছাড়া ইটাহারির সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। একজন ঘটনাস্থলেই এবং অপরজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুনসারির বিপি কৈরালা ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসে মারা যান।

দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কয়েকশ আন্দোলনকারী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এদিন রাজধানীর ফেডারেল পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে জমায়েত আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ পানি কামান, টিয়ার গ্যাস ও সরাসরি গুলি চালায়। একই ধরনের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পোখারা, বিরাটনগর, জনকপুর, হেটৌডা ও নেপালগঞ্জসহ অন্যান্য শহরে। ইটাহারিতে এক আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং দামাকে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি’র বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে আকাশে কয়েক দফা গুলি চালায়।

এর আগে নেপালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে নিরাপত্তা বাহিনী ও আন্দোলনকারীদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার নিশ্চিত করে উল্লেখ করে কমিশন বলেছে, বিক্ষোভের সহিংসতায় রূপ নেওয়া ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ দুটোই দুঃখজনক।

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর রাস্তায় সোমবার সকাল থেকেই অস্বাভাবিক উত্তেজনার আবহ ছিল। নিউ বানেশ্বর এলাকায় প্রথমে ছোট ছোট দলে জড়ো হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তরুণরা। হাতে ছিল নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড— ‘দুর্নীতির অবসান চাই’, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও’, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ মানি না’।

বিক্ষোভের শুরুতে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা হলেও, দুপুরের দিকে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়। অভিযোগ, একদল বিক্ষোভকারী হঠাৎ করে ফেডারেল পার্লামেন্টের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। নিরাপত্তা বাহিনী প্রথমে ব্যারিকেড দিয়ে ঠেকাতে চাইলেও ব্যর্থ হয়, এরপর ছুটে আসে টিয়ার গ্যাস, পানি কামান, রাবার বুলেট। পরে গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল এই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক উদ্দীপক। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রশাসন দাবি করেছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘ভুয়া খবর’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা’ বন্ধ করতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। গত বৃহস্পতিবার নেপাল সরকার ঘোষণা দেয় সরকার নির্ধারিত নিবন্ধনপ্রক্রিয়ায় অংশ না নেয়ায় ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবসহ বেশির ভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা হবে।

কিন্তু তরুণ প্রজন্ম এটিকে সরাসরি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে। নেপালের ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা জেনারেশন জেড-এর কাছে ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম শুধু বিনোদনের জায়গা নয়— বরং এটি তাদের রাজনৈতিক আলোচনা, সংগঠিত হওয়া এবং সামাজিক প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম। তারা এটাকে কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা হিসেবেই নিয়েছে।

প্রথমে আন্দোলনকারীরা সংসদ ভবনের বাইরে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দাবিতে উত্তপ্ত এই জনসমাবেশে কিছু সময়ের মধ্যে যুক্ত হয় শহরের নানা প্রান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ। বেকার যুবক, ছোট ব্যবসায়ী, এমনকি কিছু সরকারি চাকরিজীবীও ভিড়ের মধ্যে দেখা গেছে। তারা অভিযোগ তুলেছে— বছরের পর বছর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং অকার্যকর নীতি নেপালের অর্থনীতিকে স্থবির করে রেখেছে। শিক্ষিত যুবকেরা চাকরি পাচ্ছে না, সরকারি সেবা খাতে অনিয়মে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, আর রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেই স্বচ্ছতা। এই ক্ষোভই ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে উন্মুক্ত রাস্তায় তীব্র প্রতিবাদে।

প্রশাসনের দাবি, পুলিশের ওপর হামলা এবং সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার দায় আন্দোলনকারীদেরই। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য ভিন্ন— তারা বলছেন, পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগই সহিংসতার মূল কারণ। অনেকেই জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ মিছিলেই প্রথম টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়, যা জনতার মধ্যে ভীতি ও ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। এরপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পরিস্থিতি। সংঘর্ষের পর কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন বেশ কয়েকটি স্থানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেছে। মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী। তবে কারফিউ ভেঙেই রাস্তায় নেমেছে ছাত্রজনতা।

রাজনৈতিক অঙ্গনও এই ঘটনায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে এবং মৃত্যুর জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়ী করছে। নাগরিক সমাজের একাংশ বলছে, বিষয়টি শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ নয়— বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অর্থনৈতিক অসন্তোষ, শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার বহিঃপ্রকাশ। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তরুণদের এই সরব উপস্থিতি নজিরবিহীন, যা সরকার উপেক্ষা করলে পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে।