জামায়াতের উইং নাকি রাজনীতিতে নতুন শক্তি?


জামায়াত থেকে পদত্যাগ ও বহিষ্কারকৃত লোকজনের নেতৃত্বে ২০২০ সালের ২ মে যাত্রা শুরু করে ‘আমার বাংলাদেশ’ বা এবি পার্টি। দলের প্রধান উপদেষ্টা করা হয় জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে। ততদিনে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। দলটি থেকে বেরিয়ে আসা সংস্কারপন্থী নেতাকর্মীদের হাতে সৃষ্ট দলটিকে ‘জামায়াতের আরেকটি উইং’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অনেকেই।
যদিও বিষয়টি নিয়ে এবি পার্টির নেতাদের বক্তব্য হলো তাদের দলের আদর্শ জামায়াতের রাজনীতি থেকে ভিন্ন। একই সঙ্গে জামায়াতের সঙ্গে কোনো ধরনের জোটে না যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
শুরুতে জামায়াতের এক সময়ের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ও সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরীকে আহ্বায়ক এবং জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জুকে সদস্য সচিব উল্লেখ করে সে সময় ২২২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়।
মজিবুর রহমান মঞ্জু এখন এবি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জামায়াতে থাকাকালে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়েই দলটির সঙ্গে আমাদের মূল বিরোধ হয়। জামায়াত থেকে বহিষ্কার বা বেরিয়ে আসার পর দলটির সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। শুরু থেকেই আমরা বলেছি যে এ উদ্যোগের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি এটি কোনো ধর্মভিত্তিক দল নয়। এটি একটি ইনক্লুসিভ ফর্মের দল। একই সঙ্গে আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এবি পার্টির সঙ্গে আদর্শিকভাবেই জামায়াতের পার্থক্য পুরোপুরি বিদ্যমান। এ কারণে আমাদের বিরুদ্ধে জামায়াত নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা চালাল, অপবাদ দিল। এমনকি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছি এমন ফতোয়াও দিল। সুতরাং প্রথম দিন থেকেই এটি স্পষ্ট। তাই মানুষ যে ধারণাটি করেছিল সেটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণাপ্রসূত ছিল। জামায়াতের সঙ্গে এবি পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই।’
জামায়াতের সঙ্গে কোনো জোটে এবি পার্টি যাবে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যেহেতু আমাদের প্রতীক পেয়েছি, আমরা আমাদের মতো করেই নির্বাচনে যাব। জামায়াতের কোনো জোটেও আমরা যাব না। তবে বিএনপি বা নতুন সৃষ্ট কোনো দল অথবা বৈষম্যবিরোধীদের আসন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের জোট হতে পারে। সেটি নিয়ে আমরা কাজ করব।’
দলটির নির্বাচনকেন্দ্রিক সাংগঠনিক সক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘নতুন দল হওয়ায় সব জায়গায় শক্তিশালী প্রার্থী আমাদের নেই। ৩০টির মতো আসনে খুব ভালো প্রার্থী আছে। এখন ১৮০টি আসনে আমরা নির্বাচন করতে পারব। তবে নির্বাচন হতে এখনো সময় আছে। তাই ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রচেষ্টা আমাদের থাকবে।’
জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারের দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকা নিয়ে ক্ষমা চাওয়া-না চাওয়া ইস্যুতে ২০১৯ সালে দলটি থেকে পদত্যাগ করেন তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তার পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত জামায়াতের মজলিশে শুরা সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জুকে বহিষ্কার করা হয়। এর জেরে একই বছরের ২৭ এপ্রিল মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জুর নেতৃত্বে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে একটি মঞ্চের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নতুন প্লাটফর্মটি গঠনের এক বছর পর ২০২০ সালে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
জামায়াত থেকে পদত্যাগের কারণ হিসেবে এবি পার্টির সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৩৩ বছর জামায়াতের রাজনীতিতে ছিলাম। দলটির সঙ্গে আমার কর্মক্ষেত্র ছিল প্রধানত আইনি অঙ্গনে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও কাজ করেছি। নীতিগত পার্থক্যের কারণে ২০১৯ সালে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেছি। পদত্যাগের কারণ পত্রপত্রিকায় এসেছে।’
পরে এবি পার্টির প্রধান উপদেষ্টা থেকেও পদত্যাগ করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এ বিষয়ে তার বক্তব্য হলো ‘আমি এবি পার্টির উপদেষ্টা ছিলাম। বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামী লীগের অসংখ্য উপদেষ্টা আছেন, মানুষ তাদের নামই জানে না। আমি এবি পার্টির আহ্বায়ক বা সম্পাদকও ছিলাম না। উপদেষ্টা ছিলাম, এখন নেই।’
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাসেই ঈগল প্রতীকে নিবন্ধন পায় এবি পার্টি। এ বিষয়ে ইসি থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশনের রায় ও আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ‘অনুযায়ী আমার বাংলাদেশ’ পার্টিকে পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন করেছে। এ দলের জন্য ‘ঈগল’ প্রতীক সংরক্ষণ করা হয়েছে। নিবন্ধন নম্বর ৫০।’
চলতি মাসের ১১ তারিখ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবি পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে ১ হাজার ৪০০ ভোট পেয়ে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু। জেনারেল সেক্রেটারি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন আইনজীবী আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তারা আগামী তিন বছর দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া ২১ জন নির্বাহী পরিষদ সদস্যেরও নাম ঘোষণা করা হয়।
এবি পার্টির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে দলটির জেনারেল সেক্রেটারি আইনজীবী আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এবি পার্টি তার ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার করে বলেছে যে মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে নতুন প্রজন্মের রাজনীতি বিনির্মাণ করবে। আমাদের রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ রাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে সেবা ও ইস্যুভিত্তিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নাগরিকদের ভোগান্তি দূর করা। আমরা গত কয়েক বছরে এ রাজনীতির যে অনুশীলন করেছি তার সঙ্গে শুধু জামায়াত না, কোনো রাজনৈতিক দলেরই মোটাদাগে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা মধ্যমপন্থী অন্তর্ভুক্তিমূলক একটা রাজনীতি তৈরির যে চেষ্টা করে চলছি তা পুরোটাই অর্গানিক।’
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবি পার্টি। বিশেষ করে দলটির তরুণ কর্মীরা সে সময় বড় ধরনের অবদান রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই অভ্যুত্থানের পরে জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ জনপরিসরে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের সক্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন।
সুত্র:বণিক বার্তা