একটি দুর্ঘটনার ছবি যেভাবে বাংলাদেশের পরিবহন খাতের নৈরাজ্যে প্রতীক

আলোকিতপ্রজন্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:০৩ পিএম, বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ | ৬৩২

যাত্রীবাহী একটি বাস সড়কের ডিভাইডার ভেঙে পাশের লেনের একটি মাইক্রোবাসের উপর উঠে গেছে- এমন একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় এনা পরিবহনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এতে বড় কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

এছাড়া গত ২৬শে ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে একটি রেলক্রসিংয়ে বাসে ট্রেনের ধাক্কায় ৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই বাসটি যানজটের কারণে রেলক্রসিংয়েই আটকে ছিল।

"...ওরা উড়ে"

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যারা এই ছবিটি শেয়ার করে নানা ধরণের কমেন্ট করেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

বিবিসি বাংলার ফেসবুক পাতায় এ খবরটি নিয়ে যারা কমেন্ট করেছেন তাদের মধ্যে একজন সোনিয়া হোসেন। তিনি লিখেছেন, "ময়মনসিংহের এই একটা বাস সিটিং সার্ভিসে চলে তাই এদের অহংকার টা তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি। তাই বাস চালকরা নিজেদের কে বিমান চালক মনে করে।"

জিনাত ফাতেমা নামে একজন লিখেছেন, "নিরাপদ সড়কের আশা আমরা ত্যাগ করেছি। আর দরকার নাই আমাদের নিরাপদ সড়ক। শুধু একটাই অনুরোধ, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে গাট্টি বোচকা সহ অন্য কোথাও পাঠায়ে দেন। এরপর আপনাদের রাস্তায় আপনারা রেস করবেন না গোল্লাছুট খেলবেন সেগুলো আপনারা নিজেরা নিজেরা ডিসকাস করে নিয়েন।"

এনা পরিবহন নামে যে বাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছে সেই পরিবহনে নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে জানিয়েছেন মুক্তার হোসেন খান জুয়েল নামে একজন। নিজের ফেসবুক পোস্টে এই পরিবহনে যাতায়াতের সময় নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তিনি।

তিনি লিখেছেন, "আমি এনা পরিবহনের একজন রেগুলার যাত্রী, ড্রাইভারগুলি এত ফালতু ভাবে বাস চালায়! ঢাকা শহরের ভিতরে এ ধরনের দুর্ঘটনা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কত বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে।"

আয়েশা হক নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, "...রাতের বেলা তাদের বাস ড্রাইভিং আর প্লেন চালানোর মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নাই...ওরা উড়ে।"

প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৯ জনের বেশি

বিশ্বের যেসব দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি (গাড়ির অনুপাতে), বাংলাদেশ তার একটি।

নিরাপদ সড়ক চাই নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এতে প্রাণ হারিয়েছে ৪ হাজার ৯৬৯ জন।

সে হিসেবে গত বছর গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৩ জনের বেশি।

নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা আরেকটি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুধু নভেম্বর মাসেই ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৪১৩ জন।

এর আগের দুই মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে ৭০৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৮৪৬ জন। সে হিসেবে গত তিন মাসে গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৯ জনের বেশি মানুষ।

শুধু নিহত নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার সংখ্যাটিও কম নয়। প্রতি বছর অন্তত কয়েক হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় যাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এসব কারণে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের ক্ষোভের কোন কমতি নেই।

"প্রশ্রয় দেয়া হয় না"

এনা পরিবহনের চালকদের বেপরোয়া আচরণ বিষয়ে আনা সব ধরণের অভিযোগই নাকচ করেছেন এই পরিবহনটির মালিক এবং বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাস চালকদের সবাই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং সব ধরণের নিয়ম মেনেই পরিবহন চালনা করে থাকেন তারা।

চালকরা যাতে বেপরোয়া হতে না পারে তার জন্য সর্বোচ্চ গতি মানার নির্দেশনা দেয়া থাকে বলে জানান তিনি।

তবে কিছু কিছু সময় চালকরা এসব নির্দেশনা মানেন না বলেও স্বীকার করেন তিনি।

তিনি বলেন, "তারপরেও তো বুঝেন ড্রাইভাররা রাস্তায় তাদের খেয়াল-খুশি মতো অন্যায় করে। করলে আমরা কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকি। ড্রাইভারদের কোন কিছু নিয়ে প্রশ্রয় দেয়া হয় না।"

এদিকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে এনা পরিবহনকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না বলে অভিযোগের বিষয়ে মি. খন্দকার বলেন, এ অভিযোগটি একেবারেই সত্য নয়।

তিনি বলেন, "ব্যবস্থা নেয়া যায় বলেই কাল অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার সাথে সাথেই ড্রাইভারকে নিয়ে গেল অ্যারেস্ট করে, মামলা হলো।"

"আমরা যদি প্রভাবই খাটাতাম তাহলে তো আর এগুলা হতো না।"

এ ধরণের অভিযোগ সবই অনুমানের উপর করা হয় বলে মনে করেন তিনি।

নৈরাজ্যের প্রতীক

এদিকে গতকালের সড়ক দুর্ঘটনার ওই ছবিটি পরিবহন খাতে কীরকম মারাত্মক নৈরাজ্য চলছে, তার জ্বলন্ত প্রতীক বলে মনে করছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন যে, দুর্ঘটনার এ ধরণের চিত্র চিৎকার করে জানান দিচ্ছে যে, পরিবহন খাতটা আসলেই কতটা ভঙ্গুর।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক পুরো ছবিটির একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেন।

তার মতে, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মাঝখানে ডিভাইডার দেয়া হয় যাতে এটি রং-সাইডে যেতে না পারে। যেখানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে ডিভাইডারটি বেশ উঁচু ছিল। বাসটি যেভাবে সেটি পার হয়ে মাইক্রোবাসটির উপরে উঠে গেছে তাতে বোঝা যায় যে, গাড়িটির গতি অনেক বেশি ছিল এবং এটি বেপরোয়া ছিল।

কারণ যে রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি বেশ ভাল রাস্তা, অনেক প্রশস্ত, পথচারীর যত্র-তত্র পারাপার নাই। কিন্তু অসুস্থভাবে বাস চালানো, দ্রুত বেগে চালানোর কারণে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, এই বাসগুলো যেহেতু খুব একটা কেউ নিয়ন্ত্রণ করার সাহস পায় না সে কারণে এই ছবি বুঝিয়ে দেয় যে, আমাদের গণপরিবহন সেক্টরটা কত বেশি আগ্রাসী, কত বেশি উচ্ছৃঙ্খল, বিশৃঙ্খল- এটিতে তারই একটা প্রকাশ ঘটেছে।

"এই ছবি একটা অশনি সংকেত, এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে আজকে যদি ডিভাইডারটা না থাকতো তাহলে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো।"

মি. হকের মতে, এই খাতটি যারা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের অযোগ্যতা, নজরদারির অভাব এবং অবহেলার কারণেই এ ধরণের বেপরোয়া ঘটনা ঘটে থাকে।

"সুযোগ সন্ধানী"

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশে যেসব বাস সার্ভিস রয়েছে তাদের বেশিরভাগই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।

তাদেরকে নিরবচ্ছিন্ন-ভাবে দেখভাল করতে হবে। কারণ এগুলো সুযোগ সন্ধানী বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, "বেশি যাত্রী পরিবহন করবে, দ্রুত চালাবে, ইঞ্জিন নষ্ট, টায়ার ক্ষয়ে গেছে, ঝুঁকি নিয়ে চালাবে-এগুলো দেখভাল করার জন্য যে আয়োজনটা থাকার কথা সেটা নাই।"

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে অন্তত দুই বার বড় ধরণের আন্দোলন হলেও শেষ পর্যন্ত এ খাতটিতে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি।

এবিষয়ে মি. হক বলেন, এ খাতের সাথে যারা জড়িত তারা জানে যে, সাময়িক যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয় সেগুলো আসলে পরিস্থিতি সামাল দিতেই ঘোষণা করা হয়। কার্যকর করার জন্য নয়।

"প্রেশার গ্রুপ"

এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যারা কাজ করেন তারা বলছেন যে, চাইলেও অনেক সময় বিদ্যমান আইন পরিবহন খাতের উপর প্রয়োগ করতে পারেন না তারা।

পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরার কারণ হিসেবে অনেক সময়েই পুলিশ বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, বলা হয় যে, পুলিশের গাফিলতির কারণেই পরিস্থিতির উন্নয়ন হয় না।

মি. রহমান বলেন, এ ধরণের অভিযোগ আংশিক সত্য হলেও অনেক সময় আইন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, গণপরিবহন সেক্টরটি নানা ভাবে একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করে।

শক্ত করে আইন প্রয়োগ করতে গেলে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ সময় চালক এবং গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকে না। যার কারণে ওই গাড়িটি রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

কিন্তু গাড়ি রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া হলে পরিবহন শ্রমিকরা তাদের মালিকদের উস্কানিতে রাস্তায় নামে, পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়।

"রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে মন কষাকষি তৈরি হয়। তারা রাস্তায় নেমে আসে।"

সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, "ভাড়া বেশি নিক-কম নিক, যেখানে সেখানে থামুক আর না থামুক-সমস্ত কিছু মানতে হবে। মেনে তাদের মতো করে আইন প্রয়োগ করতে হবে। এটা একটা বিরাট প্রেশার গ্রুপ।"

তিনি বলেন, আইন প্রয়োগ করতে যে পুলিশের ইচ্ছা থাকে না তা নয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো এড়িয়ে যেতে হয়।

"পুলিশ অনর্থক ঝামেলা তৈরির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায় এবং ঝামেলাহীনভাবে চাকরী করতে চায়।"

তাঁর মতে, পরিবহন শ্রমিক যারা কাজ করেন তাদেরকে আইন না মানলেও প্রশ্রয় দেয় এ খাতের যারা মালিকপক্ষ আছে তারা। এক্ষেত্রে মালিক এবং শ্রমিক-দুপক্ষ মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে বলে মনে করেন তিনি।

"তখন তারা বলে যে, পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে পরিবহন নিয়ে রাস্তায় নামা যায় না। আইনটা প্রয়োগ করতে গেলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়।"

মি. হক বলেন, পরিবহন মালিক পক্ষের মোটামুটি সবাই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। তবে শুধু মালিক পক্ষ নয়, শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেন। আর এ কারণেই তারা রাজনীতিতেও একটা চাপ তৈরি করার জায়গা তৈরি করে রাখেন।

সবকিছু মিলে পরিবহন ব্যবস্থায় একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়ে আছে এবং সেটা যুগের পর যুগ এভাবেই চলে আসছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুত্র:বিবিসি বাংলা