ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত মাছ নেই যমুনায়,জেলেদের হাহাকার


যমুনায় যত দূর চোখ যায় থইথই পানি । ভরা মৌসুমেও টাঙ্গাইলে যমুনা নদীতে মাছের দেখা নেই।যমুনার বুকে জাল পেতে, দিন শেষে হতাশ হয়ে ফিরছেন মৎস্যজীবীরা। গতবছরও এই মৌসুমে জেলেদের জালে ছিল প্রচুর পরিমানে পিয়ালী,খস্ললা, বাইজা, বাইলা,গোলসা,চিংড়ি মাছ। বড় মাছের মধ্যে ছিল আইড়,বোয়াল,রিটা,রুই,মিরকা এবং ইলিশ।
কিন্তু কোথায় কী? টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলা,কালিহাতি,নাগরপুরে অংশে যমুনা নদীতে মাছ প্রায় উধাও । চলতি মৌসুমের মতো বিগত কয়েক দশকেও মাছের এতটা খরা কখনও যায়নি বলেই জানালেন মৎস্যজীবীরা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় যমুনার বুকে কিছু মাছ ধরার ছোট ছোট ডিঙ্গি ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা। জেলেরা তাতে জাল টানছে। কিন্তু জাল তুলে হতাশ হতে হয় তাদের। কিছু ছোট পিয়ালী, বাইজা ছাড়া অন্য কোনো মাছই নেই।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ১২নং মাহমুদনগর ইউনিয়নের ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীতে এই বর্ষায় ভরা মৌসুমে প্রায় ৮০ জন জেলেদের জালে এমনই চিত্র। এছাড়াও কালিহাতির গোয়লাবাড়ি, আলিপুর এবং নাগরপুরে আটাপাড়া,খকেন খাট,চৌহালির গ্রামের আরও প্রায় দুইশতাধিক জেলের একই অবস্থা।
অথচ এ সময়টা জেলেদের আয়ের বড় মৌসুম। যমুনার বুকে জাল ফেললে ওঠতো নানা জাতের মাছ। দুই-তিনজন জেলে নৌকা প্রতি দশ-বারো হাজার টাকার প্রতিদিন মাছ পেতেন। কিন্তু এবার চিত্র একেই বারেই ভিন্ন। এখন জেলেরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যার পর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত টানাজাল, বেড়জাল,দাইন,কারেন্টজাল,চায়না জাল পানিতে ফেলে সাতশ-আটশ টাকার মাছও পাচ্ছেন না। কখনো কখনো একেবারেই ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে ।
ছোটবেলা থেকে বাপের সঙ্গে নৌকায় মাছ ধরতে যেতেন স্থানীয় জেলে বাবুল শেখ (৫৩)। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন ১০-১৫ বছর আগেও যমুনা নদী ছিল অনেক পশ্চিমে প্রতিবছর বর্ষার তীব্র ভাঙ্গানের ফলে নদী এখন এত কাছে। তীব্র ভাঙ্গান ও খোর স্রোতের মধ্যেও প্রচুর মাছ পেতাম।কিন্তু এবার এ মৌসুমে কোন মাছই পাচ্ছি না। এই যমুনায় মাছের এত খরা আমার জীবনে কখনও দেখেনি। এবার নদীতে অনেক পানি কম আবার চায়না জাল ফেলার কারণেও মাছ কম পাচ্ছি আমরা।
ভরা বর্ষায় নদীতে মিলছে না ছোট ও বড় মাছ বাড়ছে দেনা, প্রতিনিয়তই হতাশা ভর করছে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের নদীর পাড় ঘেসা কুকুরিয়া,হাসানাবাদ,সরাতৈল গ্রামের মৎস্যজীবি শতাধিক পরিবারের। একদিকে করোনা কালিন লকডাউনের বির্যস্থতা আর সাথে যোগ হয়েছে প্রমত্তা যমুনার কাপ্যন্ন্যতা। ভরা মৌসুমে বিগত বছর গুলির অভিজ্ঞতা এ বছর কোন কাজেই দিচ্ছে না। নদীর পাড়ের মাছের হাহাকার আড়তে পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্খিত দাম নেই কোন দূর দূরান্তের ক্রেতাও।
পুরো পৃথিবীর করোনার অর্থনৈতিক বিপর্যযের ঢেউ সাগর মহাসাগর পেড়িয়ে পৌঁছে গেছে টাঙ্গাইলে প্রত্যন্ত চরাঞ্চালে। করোনা কালিন লকডাউনের সময়ে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় নদীতে জেলের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে সে হাড়ে মাছও কমেছে ।
কুকুরিয়া গ্রামের জেলে মমিনুল নৌকার পাটাতন থেকে গতরাতে ধরা পড়া মাছ নিয়ে আড়তের ঝুঁড়িতে ছড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাছ কিনে নেয় স্থানীয় পাইকার দাম ১১০০ টাকায়। একশ টাকার ময়লা এগারটি নোট যেন নিমিষেই বাড়িয়ে দেয় মমিনুলের ক্লান্তি। হতাশায় কোন কথাই বলতে চায় না সাংবাদিকের সাথে মমিনুল।
যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতুর ভাটি থেকে সিরাজগঞ্জের চৌহালী পর্যন্ত বাকা,আজিবর সরকার, ইসমাঈল, বেল্লাল,আলামীন সোলাইমান,জামাল,আমজাদ,সাখওয়াত শেখ,ছোরহাব আলী,আব্দুল হাকিম কত বার যে জাল ফেলেছে তার সঠিক হিসেব নেই। সবার ভাগ্যই একই রকম কাঙ্খিত মাছ নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জাল টেনে পায়নি তেমন কোন মাছ। আবার কেউ কেউ একেবারেই শূন্য হাতে ফিরছে। প্রতিটি নৌকায় অনন্ত তিন-চারজন মিলে মাছ ধরে প্রতিদিন এবং ইঞ্জিনের তেল সব খরচ মিলিয়ে কোন টাকাই থাকে না মৎস্যজীবিদের ।
এই বর্ষা মৌসুমে মাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রবীণ জেলে ছকের আলী দায়ী করলেন এবারে বর্ষায় নদীতে পানি না আসা আর ভয়াবহ মাছ ধরার চায়না ফাঁদ ও কারেন্টজালকে।
স্থানীয়রা চায়না ফাঁদকে চায়না দিয়ার বলে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এ ধরনের দীর্ঘ ফাঁদে ভরে গেছে নদীর প্রতিটি বাক। এসব মাছ ধরার চায়না ফাঁদগুলি ছোট পোনা মাছসহ সব ধরনের মাছ একেবারে পানি থেকে ছিকে টেনে তুলে, এজন্য মাছের পরিমান কমেছে নদীতে।
এসব জালের ব্যবহার নিয়ন্ত্রন করা না গেলে নদীর মাছগুলো খুব দ্রুতই বিলুপ্ত হবে বলেও জানান ছকের আলী।
আরদ মালিক বাবুল আক্তার খান বলেন যমুনা নদীতে এবার ছোট বড় তেমন কোন মাছই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যা পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু দেশে লকডাউনের কারণে আমরা মাছ বিক্রি করতে পারছি না। কারণ শহর থেকে কেউ মাছ কিনতে আসতে পারে না। মাছ কম হওয়াতে দামটাও একটু বেশি যার ফলে আরোও বিক্রি করা যাচ্ছে না।
অধিকাংশ মৎসজীবিদের অভিযোগ যে এই করোনা কালিন সময়ে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা দরিদ্র জনগোষ্টিকে ঈদ সহ বিভিন্ন সময়ে করোনা সংকটের কারণে মিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য সামগ্রী এবং নগদ অর্থ সহায়তা দিলেও জেলে পরিবারের কেউ কোন সহায়তা পায়নি।
মাহমুদনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাজেদুর রহমান এ বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন আমার ইউনিয়নে নিবন্ধিত জেলে পরিবার ৭৫ হলেও বর্তমানে চরাঞ্চলের কর্মহীন মানুষ বাধ্য হয়েই এ পেশায় যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকগুন। আমার ইউনিয়নের মৎস্যজীবিদের জন্য কোন বরাদ্দ আসে নাই। নদীতে মাছ কমায় চরাঞ্চলের মৎস্যজীবি পরিবারের সবাই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।