মির্জাপুরে নদীর পাড় ও ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়


টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নদীর পাড় ও সংলগ্ন এলাকার ফসলি জমি থেকে প্রভাবশালীরা মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই মাটি কাটা চলছে বলে নিরীহ এলাকাবাসী এর প্রতিকারে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেনা। একদিকে সরকারের উন্নয়ন কাজ চলছে অপরদিকে সরকার দলীয় পরিচয়েই স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেই উন্নয়নকে ধবংস করছে।
উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের লৌহজং নদীর চান্দুলিয়া এলাকায় নিয়মনীতি না মেনে এভাবে মাটি কাটা হচ্ছে। এতে নদী ও ফসলি জমি ভাঙনের মুখে পড়ছে। তা ছাড়া মাটিবোঝাই ভারী ট্রাক চলার ফলে মির্জাপুরের দেওহাটা-চান্দুলিয়া সড়কটিও ভেঙে আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ধবংস হচ্ছে। এতে সড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন ও পথচারী।
এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত বছর বর্ষা শেষে ওই স্থানে নদীর পাড় থেকে মাটি কেটে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ইটভাটার মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজনের ফসলি জমি ভাঙনের কবলে পড়তে থাকে। তখন বাধ্য হয়ে তাঁরাও জমির মাটি বিক্রি করা শুরু করেন। এবার বর্ষা শেষে আবার মাটি কেনাবেচা শুরু হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওই স্থান থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর মাটি কেটে ট্রাকে করে মীর দেওহাটা ও বহুরিয়া এলাকার বিভিন্ন ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মারুফ হোসেন (২০) নামের এক তরুণ মাটিবোঝাই একটি ট্রাকের চালককে চালানপত্র (মাটি নেওয়ার প্রমাণপত্র) দিচ্ছিলেন। তাঁর হাতে থাকা চালানের কাগজে মীর দেওহাটা গ্রামের আসাদ সিকদারের মালিকানাধীন মেসার্স সিকদার এন্টারপ্রাইজ লেখা রয়েছে। জানতে চাইলে মারুফ বলেন, ‘আমার কাছে একজন এই বই রাখতে দিছে। আমি রাখছি।’
তবে মাটি কাটার যন্ত্র (ভেকু) চালক রাজবাড়ী জেলা সদরের আবদুল লতিফ জানান, তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে মির্জাপুরের বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটার যন্ত্র চালান। চান্দুলিয়াতে এবার কাটা শুরু করেছেন। মারুফ ট্রাকের চালান দেন। আর মীর দেওহাটা এলাকার ইটভাটা ব্যবসায়ী শহিদুর রহমানের মালিকানাধীন ভেকু ও আটটি ট্রাক ভাড়া নিয়ে দেওহাটা গ্রামের আসাদ সিকদার, তাঁর ফুফাতো ভাই আলহাজ সিকদার ও আলহাজের বোন জামাই কামাল হোসেন সেখান থেকে মাটি কাটছেন।
মাটি ব্যবসায়ী আলহাজ সিকদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রতি ঘণ্টা ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা হারে ট্রাক ভাড়া নিয়েছেন। কয়েকজন জমির মালিকের কাছ থেকে প্রতি শতাংশ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দরে ১০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিচ্ছেন। এ মাটি স্থানীয় বিভিন্ন ইটভাটায় দিচ্ছেন। আলহাজ সিকদার আরও বলেন, ‘জমির মালিকেরা মাটি বেচে। আমরা কিনি। নদীর পাড়ে গতবার মাটি কাটছিল। এইবার তার পাশের জমির মাটি ভাঙছে। জমির মালিকেরা মাটি বিক্রি করছে।’
ট্রাকচালক সিরাজগঞ্জের মোমিন মিয়া জানান, তিনি গড়ে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ ট্রাক মাটি ভাটায় পৌঁছান।
আরেক ট্রাকচালক মাসুদ মিয়া জানান, প্রতিটি ট্রাকে গড়ে ২০০ ঘনফুট মাটি বহন করা যায়।
মাটি ব্যবসায়ী ও ট্রাকচালকদের দেওয়া তথ্যমতে, ওই স্থান থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১২০ ট্রাক মাটি কাটা হচ্ছে। এতে প্রায় ২৪ হাজার ঘনফুট মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় দেওয়া হচ্ছে।
চান্দুলিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ জানান, নদের পাড়ে তাঁর ১০৬ শতক সরিষাখেত ও ৪৬ শতক জমিতে কাঠবাগান রয়েছে। তাঁর জমির পাশ থেকে মাটি কেটেছেন প্রভাবশালীরা। এতে তাঁর খেতের মাটি ভেঙে নিচে পড়ে যাচ্ছে। মাটি কাটা বন্ধে তিনিসহ আরও কয়েকজন প্রশাসনের বিভিন্ন স্থানে লিখিত আবেদন করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।
একই গ্রামের আজিম উদ্দিন জানান, মাটি কাটায় তাঁর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য এ বছর তিনি তাঁর ১৩ শতক জমির মাটি ২৩ হাজার টাকা শতক হিসেবে বিক্রি করেছেন।
চান্দুলিয়া গ্রামের সার ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলামসহ অনেকেই জানান, ওই সড়ক দিয়ে গেড়ামারা, বহুরিয়া, চান্দুলিয়া ও দেওহাটা এই চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গেড়ামারা ও দেওহাটা উচ্চবিদ্যালয় এবং বহুরিয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীসহ আশপাশের কমপক্ষে ১৫টি গ্রামের লোকজন চলাচল করে। রাস্তায় দ্রুতগতিতে ট্রাক চলায় প্রতিনিয়ত তাদের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়। রাস্তার পাশের বাড়ি ও গাছপালা ধুলায় ভরে থাকে। এতে সর্দি-কাশিসহ নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মির্জাপুরের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল জলিল বলেন, গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ৫ থেকে ১০ টন ওজনের ট্রাক চলাচল করতে পারে। মাটিবোঝাই ট্রাকগুলো আরও বেশি ওজনের হয়ে থাকে। গ্রামীণ সড়ক দিয়ে এসব ভারী ট্রাকের চলাচল বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদমীন জানান, ফসলি জমি ও নদের পাড়ের মাটি কাটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।